উপসর্গ থাকলে টিকা নয়

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago
করোনার টিকা

কারও শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ বা উপসর্গ পাওয়া গেলে টিকা নেওয়ার আগে তার নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। আক্রান্তরা টিকা নিলে কোনো কাজে আসবে না। বিষয়টি প্রচারের মাধ্যমে সাত আগস্ট থেকে দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হবে। কারণ গ্রামে ঘরে ঘরে সর্দি জ্বর কাশি দেখা দিয়েছে।

এগুলোই করোনার উপসর্গ। এ পরিস্থিতিতে আক্রান্ত বা সদ্য করোনামুক্ত হয়েছেন এমন কেউ টিকা নিলে সুরক্ষা পাবেন না, টিকাও কাজ করবে না। কাজেই গণটিকা গ্রহণের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ থাকছে। এর মধ্যে টিকা দেওয়ার আগে নমুনা পরীক্ষার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিধিনিষেধগুলো দেশব্যাপী প্রচারের মাধ্যমে রোগীদের সতর্ক করা হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম  বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে গণটিকাদানের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেখানে কিছু বিধিনিষেধ অবশ্যই থাকবে। যাদের লক্ষণ বা উপসর্গ রয়েছে এমন কাউকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা হবে। এ ক্ষেত্রে সন্দেহভাজনদের র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করিয়ে টিকা দেওয়া হবে।

করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে প্রচারের মাধ্যমে দিনে ১০ লাখ টিকা দেওয়া হবে। ছয় দিনে দেওয়া হবে ৬০ লাখ। এটা প্রথম ডোজ হিসাবে বিবেচিত হবে। নির্ধারিত সময় পরে দেওয়া হবে দ্বিতীয় ডোজ। এ ক্ষেত্রেও দিনে ১০ লাখ টিকাই দেওয়া হবে। এভাবে এক কোটি ৩৪ লাখ ৪২ হাজার ডোজ টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে শুধু গ্রামাঞ্চলেই দেওয়া হবে এক কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার ডোজ।

ক্যাম্পেইন চলাকালীন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়ে কেন্দ্রে গেলেই পাওয়া যাবে টিকা। তবে এ ক্ষেত্রে যাদের লক্ষণ বা উপসর্গ রয়েছে অথবা যাদের উপসর্গ নেই তাদের কিভাবে আলাদা করা হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এতে টিকা প্রাপ্তিতে উপযুক্ত নন এমন ব্যক্তিদের পৃথক করার ক্ষেত্রে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে ব্যাহত হতে পারে টিকাদান কার্যক্রম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে গণহারে টিকাদানের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ দেশের গ্রামগঞ্জে ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামগুলোর প্রতিটি বাড়িতে বর্তমানে এক বা একাধিক কোভিড-১৯ লক্ষণযুক্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেকে কোভিড সংক্রমিত হলেও কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। যারা বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছেন পরীক্ষার বাইরে।

ক্যাম্পেইন থেকে এসব লক্ষণযুক্ত বা লক্ষণ ছাড়া করোনা রোগীরা টিকা নিলে এটি তাদের কোনো সুরক্ষা দেবে না। অর্থাৎ টিকা নিয়েও দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী থেকে যাবে সুরক্ষার বাইরে। তাই এসব ক্ষেত্রে টিকাদানের আগে কোভিড পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেছেন তারা।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান  বলেন, লক্ষণমুক্ত অবস্থায় যারা আছেন তাদের টিকা দিতে হবে। কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পরে সম্পূর্ণ সুস্থ না হয়ে টিকা নেওয়া যাবে না। বিশেষ করে যাদের লক্ষণ থাকবে তাদের পরীক্ষা করে টিকা নিতে হবে।

এটি টিকা গ্রহীতার নিজের নিরাপত্তার জন্য করতে হবে। কারণ শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থাকলে টিকা কোনো কাজ করবে না। তিনি বলেন, টিকাদানের ক্ষেত্রে কোভিড পরীক্ষা কখনোই পূর্বশর্ত নয়। তবে যাদের লক্ষণ আছে তাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে টিকা দিতে হবে। নয়তো ব্যক্তিও সুরক্ষিত হবে না এবং টিকাও কোনো কাজে আসবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ক্যাম্পেইন আকারে টিকার কার্যক্রম পরিচলনার মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ৭ থেকে ১২ আগস্ট এই কার্যক্রম চলতে পারে। শহর ও গ্রামাঞ্চলে একযোগে টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। শহরাঞ্চলে মডার্না ও গ্রামাঞ্চলে সিনোফার্ম টিকা দেওয়া হবে।

বর্তমানে দেশে ৫৫ লাখ মডার্না ও ৫১ লাখ সিনোফার্ম টিকা মজুত রয়েছে। ক্যাম্পেইনে ৬০ লাখ টিকা প্রথম ডোজ হিসাবে এবং অবশিষ্ট দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে সংরক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া চলমান কেন্দ্রগুলো আগের মতো চলমান থাকবে এবং শুধু দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। বস্তি ও কারখানাগুলোতে টিকা কার্যক্রম ও ক্যাম্পেইন পাশাপাশি চলমান থাকবে। বিদেশগামী জনগোষ্ঠী বিদ্যমান পদ্ধতিতেই নির্ধারিত টিকা নিয়ে সনদ গ্রহণ করবেন।

ছয় দিনব্যাপী পরিচালিত এই টিকাদান ক্যাম্পেইনে সারা দেশে ১৫ হাজার ২৮৭টি ওয়ার্ডে এক কোটি ৩৪ লাখ ৪২ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে দেশের গ্রামাঞ্চলের ১৩ হাজার ৮০০ ওয়ার্ডে এক কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার ডোজ, সিটি করপোরেশনগুলোর ৪৩৩টি ওয়ার্ডে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ ডোজ এবং পৌরসভাগুলোয় এক হাজার ৫৪ ওয়ার্ডে আট লাখ ৪৩ হাজার ২০০ ডোজ টিকা দেওয়া হবে।

এর মধ্যে সিটি করপোরেশনগুলোর প্রতি ওয়ার্ডে একটি স্থায়ী ও দুটি অস্থায়ী কেন্দ্র সপ্তাহে ছয় দিন কোভিড টিকা দেওয়া হবে। উপজেলা ও পৌরসভার প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে টিকাদান টিম থাকবে, যেখানে সপ্তাহে চার দিন কোভিড টিকা দেওয়া হবে।

পরিকল্পনায় আরও বলা হয়েছে, ক্যাম্পেইন চলাকালে কেন্দ্র থেকে টিকা নিতে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে আনতে হবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা নিজ নিজ ওয়ার্ডে টিকাদান কেন্দ্র নির্ধারণ করবেন। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ওয়ার্ডপ্রতি টিকা টিম ও ভ্যাক্সিনেশন নির্ধারণ করবেন। এ ক্ষেত্রে এনজিও, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ অন্যান্য সেক্টর সহায়তা দেবে।

সুরক্ষা ওয়েব পোর্টাল/অ্যাপসে সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও গ্রামঞ্চলের ওয়ার্ডভিত্তিক নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হবে। উপজেলা পর্যায়ে বিদ্যমান সাব-ব্লক অনুযায়ী টিকাদান পরিচালিত হবে। এক্সেল শিটভিত্তিক নিবন্ধনের মাধ্যমে ক্যাম্পেইনে টিকাদান পরিচালিত হবে এবং টিকা কার্ড দেওয়া হবে। প্রথম ডোজের নিবন্ধন যারা করেছেন তারা ক্যাম্পেইনে টিকা নিতে পারবেন।

বারকোডের মাধ্যমে সুরক্ষা পোর্টালে এ তথ্য হালনাগাদ করা হবে। ক্যাম্পেইন চলাকালে টিকাকেন্দ্রগুলোতে শুধু বিভিন্ন টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। ওইসব কেন্দ্র থেকে এ সময় প্রথম ডোজের কোনো এসএমএস দেওয়া হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জুলাই মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশে টিকা নিয়েছেন এক কোটি ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৭ জন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৭১ লাখ ৮৯ হাজার ৩৩২ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৪০৫ জন। দুই ডোজ মিলিয়ে ঢাকা বিভাগে টিকা পেয়েছেন ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৫ জন এবং ঢাকা মহানগরে পেয়েছেন ২০ লাখ ৩১ হাজার ২১৪ জন।

চট্টগ্রাম বিভাগে পেয়েছেন ২২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫৮ জন; খুলনা বিভাগে ১৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৬৫ জন; রাজশাহী বিভাগে ১২ লাখ ১৭ হাজার ৯৮১ জন; রংপুর বিভাগে ১১ লাখ ২৩ হাজার ৮৫৭ জন; সিলেট বিভাগের পাঁচ লাখ ৯০ হাজার ১৬২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ৪৭৫ জন; বরিশাল বিভাগে পাঁচ লাখ দুই হাজার ৫০ জন।

এই হিসাবে দেশের মোট ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ মানুষ এক ডোজ টিকা পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনে এক ডোজ টিকা পেয়েছেন ১৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ; ঢাকা বিভাগে ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ; খুলনা বিভাগে ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ; চট্টগ্রাম বিভাগে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ; রংপুর বিভাগে ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ; রাজশাহী বিভাগে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ; বরিশাল বিভাগে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ; সিলেট বিভাগে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, গত ২৪ জুলাই পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেয়েছে এক কোটি ১১ লাখ ১৮ হাজার ১১৯ জন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৩৩ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪২ লাখ ৯৮ হাজার ৮৬ জন। সিনোফার্মের টিকা পেয়েছেন এক লাখ ২৭ হাজার ৫১১ জন।

এর মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন এক লাখ ২২ হাজার ৯৬৪ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন চার হাজার ৫৪৭ জন। ফাইজারের প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৫০ হাজার ২১৭ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ১৩৮ জন। মডার্নার টিকা পেয়েছেন ৩০ লাখ ছয় হাজার ১২৩ জন। এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া এখনো শুরু হয়নি।

বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম নির্ধারিত বুলেটিনে জানিয়েছেন, শিগগিরই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হবে। তিনি বলেন, দেশে প্রথম করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার মাধ্যমে।

কিন্তু মাঝে টিকা সরবরাহ বন্ধ থাকায় দ্বিতীয় ডোজের জন্য অনেকেই অপেক্ষায় রয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যেই জাপান সরকারের কাছ থেকে কিছু পরিমাণ টিকা পেয়েছি। খুব দ্রুত দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষমাণদের টিকা দেওয়া শুরু করব।