তিনি এসেছেন আজ সকালে। যে কাজে এসেছেন, তা মোটামুটি শেষ। এরই মধ্যে দু’বার কাছাকাছি এলেও সকাল এবং দুপুরে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সাথে সাক্ষাত হয়নি তার। সেটাও অবশেষে হয়ে গেছে ঘণ্টা কয়েক আগে। তবে কি কাল রোববারই দেশে ফিরে যাবেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে?
তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউ। গায়ে সাবেক কোচের তকমা লেগে গেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে তার সব রকম সম্পর্ক চুকে-বুকে গেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে অধ্যায় এখন অতীত। তার এবারের আসাটা মূলতঃ নিজের গরজে। বিসিবির ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ নেয়া আর দেনা-পাওনা চুকিয়ে ফেলা। তারপরও তার আসা-থাকার সমুদয় খরচ বিসিবিই বহন করছে। তাই হাথুরু কবে যাবেন নাকি যাবেন না- এ খবরটা বিসিবির কর্তাদেরই জানার কথা।
কিন্তু হাথুরুসিংহে ঠিক কবে যাবেন? বিসিবির কর্তাদের কেউ তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তার ফেরা নিয়ে দু’রকম কথা শোনা যাচ্ছে- এক পক্ষ বলছে তিনি কাল রোববার ফিরে যাবেন। আবার অন্য পক্ষ জানাচ্ছে কাল নয় পরশু সোমবারও যেতে পারেন হাথুরু।
তবে যেদিনই যান না কেন, বিদায় বেলায়ও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ওপর সব দায় দায়িত্ব চাপিয়ে যাচ্ছেন হাথুরুসিংহে। বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন এবং পরিচালক জালাল ইউনুস-আকরাম খান এবং প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দীন চৌধুরী সুজনের সাথে বৈঠকে সন্ধ্যার পর হোটেল র্যাডিসন ব্লুতে বসে অনেক কথাই বলেছেন হাথুরুসিংহে। সেখানে অনেক কথার ভীড়ে তার পদত্যাগের প্রকৃত কারণও উঠে এসেছে।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন আজ রাতে র্যাডিসন হোটেলে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আলাপে সে বিষয়গুলোও তুলে ধরেছেন। সাবেক কোচ হাথুরুসিংহের সাথে তার নিজের এবং বোর্ডের কয়েকজন, শীর্ষ কর্তার কথা-বার্তা মিডিয়ার সামনে তুলে ধরে পাপন যা বলেন, তার সারমর্ম হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বিশেষ কওে, সিনিয়র ক্রিকেটারদের আচরণে যারপরনাই অসন্তুষ্ট হাথুরুসিংহে। তাদের আচরণ এবং মানসিকতা তার ভাল লাগেনি। যা নিয়ে তিনি রীতিমত অসন্তুষ্ট।
বিশেষ করে সাকিব আল হাসানেরমত অতি নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে না গিয়ে বিশ্রামে কাটাবে- এটা নাকি হাথুরু মোটেই মেনে নিতে পারেননি। তার কাছে সাকিবের আচরণ ও বিশ্রাম নেবার সিদ্ধান্তটাকে দেশের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ বড় করে দেখার মতই মনে হয়েছে।
হাথুরুর পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে মিডিয়াকে বিসিবি প্রধান বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা সফরটা নিয়ে প্রথম থেকেই হাথুরুর একটা অসন্তুষ্টি ছিল। এখানে খেলোয়াড়দের মানসিকতা নিয়েও তার একটা সমস্যা ছিল। এটা যে ছিল না, তা তো না। উদাহরণ হিসেবে, এই যে সাকিব টেস্ট খেলতে যাবে না এটাও সে মেনে নিতে পারেনি। সে একটু ভিন্ন ধরনের। আমাদের মতো সবাই তো একরকম হয় না। তার কথা, কেন খেলবে না। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার দেশের জন্য কেন খেলবে না? এতবড় একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। তারপর আরও বদলি। স্বাভাবিকভাবে আমাদের সাথে যে কথাগুলো বলতে পারতো, সে কথাগুলো হয়নি এখানে। একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ ছিল। প্লাস ওখানে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিল। সবকিছু মিলে একটা সময় তার মনে হয়েছে যে, এ ধরনের দলকে আমার করার কিছু নাই, আমার আর দেয়ার কিছু নেই। যা দেয়ার ছিল, আমি দিয়েছি। এখন আর এই দলকে আমার দেয়ার কিছু নাই। তাই আমার এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। সে ভেবেছে যে, এখন আমার এখানে থাকার দরকার নেই। কারণ সে মনে করেছে, যেভাবে চলছে এভাবে চললে সে আর বাংলাদেশকে সামনে নিয়ে যেতে পারবে না।’
এদিকে হাথুরু সকালে আসলেও একই হোটেলে তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক ও কোচিং স্টাফদের সাথে আলোচনা করতে র্যাডিসনে গিয়েও দুপুরে দেখা করেননি বিসিবি প্রধান। সন্ধ্যার ঘণ্টা খানেক পর তিনি র্যাডিসনে গিয়ে হাথুরুরর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তার ভাষায়, সে সময় অনেক্ষণ কথা হয়েছে। তখনই নাকি হাথুরু তার কাছে ওপরের কথা গুলো বলেছেন।
এগুলো জানিয়ে নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের সাথে এবার এটাই প্রথম দেখা। বেসিক্যালি আজকে অনেকক্ষণ ধরেই কথাবার্তা হয়েছে। তখন আমাদের সিইও ছিল। সুজন (খালেদ মাহমুদ), জালাল ভাই, (আইএইচ) মল্লিক ছিল। ওরা সবাই মিলে যে আনুষ্ঠানিক বিষয়গুলো ছিল, সেগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছে। যা যা কাগজপত্র ছিল ওগুলো ওরা সবকিছু শেষ করেছে। ঠিক করেছে অন্তত, কোনটা কখন করবে।’
হাথুরুর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয় সম্পর্কে পাপন বলেন, ‘আমার ব্যাপারটা ছিল একেবারেই সৌজন্য সাক্ষাৎ। যেহেতু বাংলাদেশে এসেছে, সেও চাচ্ছিল আমার সাথে দেখা করতে। প্রথমে একবার ভেবেছিলাম হয়তো দেখা হবে না। তারপর ভাবলাম, ঠিক আছে এতদিন ছিল আমাদের সাথে একবার দেখা করাই উচিত। সে কারণেই একটা সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য এসেছিলাম।’
পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে হাথুরুর ব্যাখ্যা তার অনেকটাই জানা ছিল- মন কথা জানিয়ে পাপন আরও বলেন, ‘এগুলো যে জানতাম না এরকম বলা ভুল হবে। এগুলো সবই জানা, জানি না যে তা নয়। সে কয়েকটা কথা বলেছে। আমাদের বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য সে যেটা মনে করে, আমাদের এখন কী কী করণীয়। একটা লেভেলে তো আমরা উঠে এসেছি। এরপর যদি আমরা সামনে যেতে চাই, তাহলে কী কী করা উচিত বা কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে এগুলো দূর করা বা আমাদের দেখা উচিত। যেমন ধরুন, কোনো প্লেয়ার নিয়ে যদি কথা উঠে, সে বলেছে এ প্লেয়ার তো ১০ বছর ধরে তোমাদের সাপোর্ট দিয়ে এসেছে, তোমরাও দিয়ে এসেছ। একটা প্লেয়ারের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিলে তো তার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ওর কাছ থেকে সেরাটা নিতে হবে। আমি একটা উদাহরণ হিসেবে বলছি। তাই ও যে জিনিসটা বলেছে যে, কোথায় কি ধরনের মানসিকতা, মাইন্ডসেটের ঘাটতিগুলো আছে, এগুলোকে যদি আমরা উতরাতে পারি, সে বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ আরও উপরে যাবে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় আমাদের পুরো খেলা, পারফরম্যান্স, মাইন্ডসেট নিয়ে সে অত্যন্ত হতাশ। সে কখনো চিন্তাই করতে পারে না বাংলাদেশ এ ধরনের একটা খেলা খেলতে পারে। তার ভাবনাতেই ছিল না।’
এর বাইরে হাথুরসিংহের উপলব্ধির কথা জানতে চাওয়া হলে বিসিবি সভাপতি বলেন, ‘হাথুরু তার ফাইন্ডিংসগুলোও দিয়েছে। অনেকগুলো ফাইন্ডিংস আছে। আমরা এগুলো দেখবো। আমাদেরকে বলে দিয়েছে। মুখে অনেক কিছু বলেছে। রিপোর্টও দিচ্ছে। দিয়েছে, আরও দিচ্ছে। এটা তো শেষ না। আমাদের এখানে আরও কয়েকদিন লাগবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তো ২০ তারিখে জয়েন করছো শ্রীলঙ্কায়। সে বললো না, এটা বোধহয় কমিউনিকেশনের গ্যাপ। আমার জানা নেই। ২০ তারিখ জয়েন করছি না। এ মাসটা আছি। এটাই ও বলেছে। এর মাঝে আমি, আমার যা যা জানা তোমাদের দিব। তোমরা এটা দেখ, দেখে এমন কিছু করো না যে এটা ক্রিকেটার বা ক্রিকেটের ক্ষতি হয়। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিও না। এগুলো তোমাদের জানার জন্য বলছি। এগুলো সব দেশেই হয়তো থাকে। এমন কিছু না যে, খুব সিরিয়াস কিছু; কিন্তু এটা যদি দূর করা যায়, তাহলে আমাদের জন্য অনেক ভালো হবে। এটাই সে বলতে চাচ্ছে।’
বিসিবি সভাপতির শেষ কথাগুলোতে আছে বড় ইঙ্গিত। তার মানে ক্রিকেটারদের কারো কারো সম্পর্কে নিশ্চয়ই বড় ধরননের অভিযোগ ও নেতিবাচক রিপোর্ট দিয়ে যাবেন হাথুরু। সেটা যে মুশফিক ও সাকিবের বিপক্ষে- তা কি আর নতুন করে বলার অবকাশ আছে?