২৫০ টাকার পুঁজিতে শুরু, আজ তিনি ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

১৯৮৮ সালে হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে যায় তানিয়ার। পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি পরিবার। নতুন করে জীবন চলার পথে শুরুতেই হোঁচট খান কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ এলাকার মৃত আমিনুল হকের মেয়ে তানিয়া আক্তার। নিজের মেধা আর অদম্য সাহস আজ তাকে একটা শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। এখন আর কারও ওপর নির্ভর করতে হয় না তানিয়াকে।

মাত্র ২৫০ টাকা পুঁজি দিয়ে শহরের একটি স্কুলে বাচ্চাদের কাছে চকলেট বিক্রির মাধ্যমে শুরু করেন ক্ষুদ্র ব্যবসা। আজ তিনি অর্থনৈতিকভাবে একজন সফল নারী। নিজের ব্যবসার পরিধি বাড়িয়েছেন। ব্যবসার পাশাপাশি অবদান রাখছেন সমাজসেবায়। তবে তানিয়ার চলার পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তৈরি করতে হয়েছে আজকের অবস্থান।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবার পাঁচ মেয়ে আর দুই ছেলের সংসারে তানিয়া সবার বড়। ১৯৮৮ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মো. শফিকুল আলম নামের এক যুবকের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে হয় তানিয়ার। পরের বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন।

এরপরই শুরু হয় কঠিন সংগ্রাম। ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিলে হোস্টেল সুপারের চাকরি নেন। স্বামীও একই মিলে চাকরি করতেন। ২০০২ সালে মিলটি বন্ধ হয়ে গেলে আবারও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন তানিয়া আক্তার। করিমগঞ্জে স্বামীর বাড়িতে গিয়ে একটি ছোট্ট মুরগির খামার শুরু করেন। সেখানেও প্রকৃতির বাধা! বার্ডফ্লুতে মুরগি মরে গেলে এক ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তানিয়া আক্তার। মনোবল হারাননি। এরই মধ্যে সংসারে আসে আরও দুই মেয়ে।

২০০৬ সালে তিন সন্তান নিয়ে আবারও কিশোরগঞ্জে চলে আসেন। একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করান। ভাবতে থাকেন কী করা যায়।

কিশোরগঞ্জ শহরের খরমপট্টি এলাকায় ‘টিউবরোজ’ নামের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে মেয়েকে পড়ানোর সময় তার মাথায় আসে এখানেও তো কিছু একটা করা যায়। ২৫০ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন শিশুদের কাছে চকলেট বিক্রি। ধীরে ধীরে তার পরিচিতি বাড়তে থাকে। স্কুলে আসা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছে কানের দুলসহ অন্যান্য অর্নামেন্টস বিক্রি শুরু করেন।

একদিন স্কুলে পোশাক বিক্রি করতে আসেন এক নারী। তানিয়ার মাথায় আসে তিনিও তো এ ব্যবসা শুরু করতে পারেন। ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে তাকে নিয়ে নারী ও শিশুদের পোশাক কিনতে চলে যান নরসিংদীর বাবুরহাট। স্কুলের ভেতরেই শুরু করেন বাটিকের থ্রি-পিস ও শিশুদের জামা-কাপড় বিক্রি। ১০ হাজার টাকার পোশাক বিক্রি করেন দুদিনেই! এরপর বেছে নেই এই ব্যবসা।

২০০৯ সালে শহরের বকুলতলা এলাকায় ছোট্ট একটি দোকানে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। সেই থেকে চলছে এখনও।

বর্তমানে খরমপট্টি এলাকায় বড় মেয়ে সামান্তার নামে ‘সামান্তা ফ্যাশন’ নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তানিয়া আক্তার। কোনো কর্মচারী নেই। একাই সামলান ব্যবসা। তাকে সহযোগিতা করেন দুই মেয়ে সামান্তা ও অনন্তা। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জামালপুর, বাবুরহাটসহ দেশের বাইরে কলকাতা থেকে নিজেই জামাকাপড় কিনে আনেন শোরুমে বিক্রির জন্য। সব আইটেম নারীদের জন্য। বর্তমানে এ ব্যবসা থেকে মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লাভ আসে। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি একটি সমবায় সমিতি পরিচালনা করেন। ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। কোথাও মেলা হলে কিংবা সরকারি কোনো অনুষ্ঠান হলে ডাক পড়ে তানিয়ার।

সংগ্রামী নারী তানিয়া আক্তার এখন শুধু প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীই নন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন চেম্বার অব কমার্সেও। বর্তমানে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি এসেছে সম্মানও। অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন প্রশিক্ষণে।

গত বছর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশেষ কার্যক্রমের আওতায় অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’র সম্মানে ভূষিত হন সফল নারী তানিয়া আক্তার।

তানিয়া আক্তারের বড় ছেলে ইয়াসির আরাফাত তনয় স্ত্রীকে নিয়ে বিকাশ অফিসে চাকরি করেন। বড় মেয়ে নাফিসা তাসলিম সামান্তা শহরের সরকারি গুরুদয়াল কলেজে প্রথমবর্ষে লেখাপড়া করছেন। ছোট মেয়ে নাহিদা তাসনিনা অনন্তা এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। দুজনই কৃতী শিক্ষার্থী। তারা লেখাপড়ার ফাঁকে ব্যবসার কাজে মাকে সাহায্য করেন।

কিশোরগঞ্জ টিউবরোজ কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক আমিনুল ইসলাম তারেক বলেন, ‘তানিয়া আক্তার একজন সৎ ও সাহসী নারী। ছোটবেলা থেকে তার মধ্যে একটা কিছু করার উদ্যমতা দেখেছি। তাই আমাদের স্কুলের ভেতর ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য সুযোগ করে দেই। আজ তার সফলতায় আমাদের খুব ভালো লাগছে।’

কিশোরগঞ্জ জেলা উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ফাতেমা জহুরা বলেন, ‘তানিয়া আক্তার একজন সংগ্রামী নারী। সততা ও সাহসের সঙ্গে পথ চললে কেউ তাকে আটকাতে পারে না—এটাই প্রমাণ করেছেন তিনি। অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও বিনয় তাকে সামনে চলছে সাহায্য করেছে। গত দুই মেয়াদ ধরে সফলতার সঙ্গে চেম্বারের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।’

কিশোরগঞ্জ জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. মামুন অর রশীদ বলেন, ‘তানিয়া আক্তার একজন সংগ্রামী নারী। তার মধ্যে বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা ছিল। শত বাধা উপেক্ষা করে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কীভাবে বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, সেটি তিনি জানেন। এজন্য সফলতা এসেছে। আমরা তাকে যে কোনো সহযোগিতায় সবসময় পাশে থাকব।’

স্বপ্নজয়ী তানিয়া আক্তার বলেন, ‘আমি মনে করি কোনো কাজই নিন্দার নয়। পাশের লোকে কী বললো তা অগ্রাহ্য করে সততার সঙ্গে কাজে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। এ সফলতার পেছনে আমার পরিবার, ছেলেমেয়েসহ অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে টিউবরোজ কিন্ডারগার্টেনের মালিক আমিনুল ইসলাম তারেক ও তার স্ত্রী আরিফা ইসলাম লাকি আমার চলার পথে শুরুতেই সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন। তাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।’