মোঃ শাহাজাদা হিরা বরিশাল পাসপোর্ট অফিসের সেবায় বিদ্যমান অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতি চিহ্নিত করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় যে, জরিপের অন্তর্ভুক্ত সেবাগ্রহীতাদের ৭১.১% পাসপোর্ট সেবায় অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। পাসপোর্ট সেবায় অনিয়ম, হয়রানির ও দুর্নীতির ধরণ বিশ্লেষণে দেখা যায় সেবাগ্রহীতাদেও ৫৪.০% ঘুষ বা নিয়মবর্হিভূত অর্থ দেওয়া ৩২.৩% সময়ক্ষেপন এবং ০.৬% আত্মসাৎ ও প্রতারণার শিকার হয়েছে। পাসপোর্ট সেবায় ঘুষ বা নিয়ম-বর্হিভূত অর্থ দেওয়ার গড় পরিমান ১৮৫৪ টাকা। গ্রামের সেবাগ্রহীতাদেও মধ্যে ৭৫.৭% এবং শহরের সেবাগ্রহীতাদেও মধ্যে ৬১.৭% অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন বরিশাল সনাক সভাপতি অধ্যক্ষ গাজী জাহিদ হোসেন।
গতকাল ৩০ নভেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায়। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিডিএস) মিলনায়তনের টিআইবি’র অনুপ্রেরণায় গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), বরিশাল এর আয়োজনে “ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, বরিশাল: পাসপোর্ট সেবায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় ” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন ও সুপারিশ উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আলী হোসেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বরিশাল সনাক সভাপতি অধ্যক্ষ গাজী জাহিদ হোসেন, সনাক সদস্য প্রফেসর এম মোয়াজ্জেম হোসেন (যুগ্ম সচিব-অব:), অ্যাড. মানবেন্দ্র বটব্যাল, প্রফেসর শাহ সাজেদা, জনাব নূরজাহান বেগম, জনাব সাইফুর রহমান মিরণ, জনাব শুভংকর চক্রবর্তী এবং টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জনাব মো. শাহ্নূর রহমান।
আলোচ্য গবেষণায় বরিশাল পাসপোর্ট অফিসের মোট ৩৫০ জন সেবাগ্রহীতার ওপর পরিচালিত একটি প্রতিনিধিত্বশীল জরিপ ছাড়াও মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার, নিবিড় সাক্ষাৎকার, দলগত আলোচনা, কেস স্টাডি ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিসহ পাসপোর্ট সেবা বিষয়ক প্রবন্ধ, গবেষণা প্রতিবেদন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করা হয়েছে। নভেম্বর ২০১৬ থেকে আগষ্ট ২০১৭ সময়ের মধ্যে এই গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। সেবাগ্রহীতা জরিপটি ৮ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সময়ের মধ্যে সম্পাদিত হয়।
বরিশাল পাসপোর্ট অফিসের সেবায় বিদ্যমান অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতি চিহ্নিত করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ভপাসপোর্ট অফিসের সেবায় নির্ধারিত ফি’র বাইরে ঘুষ বা নিয়ম-বর্হিভূত অর্থ দেওয়ার গড় পরিমান ১৮৫৪ টাকা। নতুন পাসপোর্ট আবেদনে সেবাগ্রহীতাদের ৮৯.৪% পুলিশী তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার এবং তাদের সকলকে ঘুষ বা নিয়ম-বর্হিভূত অর্থ হিসেবে গড়ে ৮৯৬ টাকা দিতে হয়েছে। পুলিশ প্রতিবেদন প্রণয়নে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) কর্তৃক আবেদনপত্রে অযথা ত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা, জঙ্গি কার্যক্রম বা অন্য রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততার ভয় দেখানো, বাড়িতে না এসে চায়ের দোকান বা থানায় ডেকে পাঠানো, নিয়ম-বর্হিভূত অর্থ বা ঘুষ দাবি করার বিভিন্ন অভিযোগ উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
এছাড়া, পাসপোর্ট বিতরণে ৩২.৩% সেবাগ্রহীতার নির্ধারিত দিনে পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হয়েছে। বিলম্বের গড় মাত্রা ছিল ৮ দিন। গবেষণা অনুযায়ী জরিপের আওতাভুক্ত বরিশাল পাসপোর্ট অফিসের সেবাগ্রহীতাদের ৫৬.৩% দালাল বা অন্যের সহযোগিতা নিয়েছে। দালালদের একাংশ পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এসবি পুলিশের একাংশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। পাসপোর্ট প্রার্থীদের কাছ থেকে দালালরা যে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করে তার একটি অংশ পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এসবি পুলিশের একাংশকে প্রদান করে থাকে। বরিশাল পাসপোর্ট অফিসের দালালির সাথে স্থানীয় নামধারী সাংবাদিক, পুলিশের একাংশ ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের একাংশ জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যারা দালালের সহযোগিতা নিয়েছে তাদের ৭২.১% বিভিন্ন ঝামেলা ও ভোগান্তি (যেমন-দীর্ঘ লাইন, একাধিকবার আসা ইত্যাদি) এড়িয়ে চলা, ৬২.৯% দালালের সহযোগিতা ছাড়া আবেদনপত্র জমা দিলে কর্তৃপক্ষ জমা নেয় না, ৩৬.৫% নিয়মকানুন সম্পর্কে না জানার কারণে সহযোগিতা গ্রহণ, ১১.৭% নির্ধারিত সময়ের পূর্বে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য, ৬.১% পুলিশী তদন্তে হয়রানি এড়ানোর জন্য এবং ৪.৬% সময়ের অভবে দালালের সহায়তা নেওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন।
বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, বরিশাল-এর পাসপোর্ট সেবার বিভিন্ন ধাপে বিদ্যমান অনিয়ম ও দুর্নীতিসমূহ চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন নিশ্চিতে বরিশাল পাসপোর্ট অফিসে প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, আবেদনপত্র সত্যায়ন, প্রত্যয়ন ও পুলিশ প্রতিবেদনের বিধান বাতিল এবং দালালের দৌরাত্ম্য নিমূর্লসহ তের দফা সুপারিশ উত্থাপন করেছে গবেষণা প্রতিবেদনে উপস্থাপিত সুপারিশসমূহের উল্লেখযোগ্য হল: বরিশাল পাসপোর্ট পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীদের যোগসাজশে দালালচক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে তাদের শাস্তির আওতায় আনা; অফিসের বিদ্যমান জনবলের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আবেদনপত্র জমাদান, প্রি-এনরোলমেন্ট, বায়ো-এনরোলমেন্ট ও বিতরণ কাউন্টারে অফিস চলাকালীন সময়ে কর্মরত জনবলের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ; নারী, শিশু, অসুস্থ, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক প্রি-এনরোলমেন্ট ও বায়ো-এনরোলমেন্ট কাউন্টারের ব্যবস্থা করা; অভিযোগ বক্স স্থাপন করে অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; বরিশাল পাসপোর্ট অফিসের স্থানীয় ওয়েবপোর্টাল নিয়মিত হালনাগাদকরন।
এছাড়া বিদ্যমান পুলিশ প্রতিবেদন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সাথে মাসিক ভিত্তিতে সমন্বয় সভা আয়োজন পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাতিল এবং সকল নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ তৈরির পাশাপাশি স্মার্ট কার্ড বিতরণ, চাহিদার সাথে সংগতি রেখে বরিশাল পাসপোর্ট অফিসে জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের সরবরাহ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ করার সুপারিশ করা হয়।