কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় দিন দিন অরক্ষিত হয়ে পরেছে বরিশাল বিমান বন্দর। বিমান বন্দরের চার দিকে সঠিকভাবে মনিটরিং না করায় গৃহপালিত পশু, কুকুর, কাক ঢুকে পরে বিড়ম্বনার সৃষ্টি করছে। এসব পশু-পাখির অবাধ যাতায়াতে যেকোন সময়ে বিমান দুর্ঘটনার কবলে পরতে পারে বলে অভিযোগ করেছে বিমান যাত্রীরা। সর্বশেষ শুক্রবার এমন একটি দুর্ঘটনার উপক্রম হলেও শেষ পর্যন্ত কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে আতংকিত হয়ে পরে বিমানের যাত্রীরা।
জানা গেছে, শুক্রবার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি বহনকারী বিমান অবতরণ করে বিমান বন্দরে। বিমানটি অবতরণের আগে মূল রানওয়েতে অনেকগুলো কুকুর ছুটোছুটি-খেলাধুলা করছিল। এতে করে ওই বিমান অবতরণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিমানটি অবতরণের সময়েও কুকুরগুলো রানওয়ে না ছাড়ায় দুর্ঘটনার শঙ্কা সৃষ্টি হয়। এমন ঘটনার উদ্ভব হয় বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ বিমান অবতরণের পূর্বে রানওয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায়। যদিও ভাগ্যক্রমে বিমানের শব্দে কুকুরগুলো রানওয়ে ছেড়ে বাইরে অবস্থান নেয়।
বিমান বন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিমান অবতরণ করে রানওয়েতে হাজার মাইল গতিতে ছুটে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে থামে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওই রানওয়ে পার হওয়ার সময়ে বিমানের চাকা বা পাখায় পশু-পাখি আটকে গেলে বিমানে আগুন লেগে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটতে পারে।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, বিমান অবতরণের সময়টি অত্যান্ত ক্রিটিক্যাল। এই সময়ে সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করতে হয়। একটি অনাকাঙ্খিত অনুপ্রবেশ মারাত্মক দুর্ঘটনার সূত্রপাত করে দেয়।
যদিও পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বরিশাল বিমান বন্দরের ব্যবস্থাপক। তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
এই ব্যবস্থাপক দাবী করেছেন, বিমান অবতরণের সময়ে রানওয়েতে কুকুর ছিল এমন কথা যারা বলছেন তারা মিথ্যা কথা বলছেন। সাধারণত আমাদের বিমান বন্দরে দুটি কুকুর সবসময়ে থাকে। আর আজকের (২৫ অক্টোবর) বিকেলে নভোএয়ারের ফ্লাইটটি অবতরণের সময়ে কুকুর দুটি এপ্রোন সাইটে ছিল। অনিরাপত্তার কারন হয়ে ওঠেনি। যারা কুকুর দুটি দেখেই আতঙ্কিত হয়েছেন তারা না বুঝে আতঙ্কিত হয়েছেন।
এই ব্যবস্থাপক বলেন, আমরা বিমান বন্দরের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বদা কাজ করছি। প্রথমে কুকুর রানওয়েতে ছিল না, পরে দুটি কুকুরের তথ্য স্বীকার করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বিমান বন্দরের ব্যবস্থাপকের নাম রথীন্দ্রনাথ চৌধুরী। জানা গেছে, বিমান চলাচলের আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী রানওয়ের পাশে ৫০০ ফুট ফাঁকা জায়গা (স্পেস) থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বরিশাল বিমানবন্দরে আছে মাত্র ৩০০ ফুট জায়গা। বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারে নেই আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। অগ্নিনির্বাপণসহ উদ্ধার কার্যক্রমও মানসম্পন্ন নয়।
বিমানবন্দরের সীমানাপ্রাচীরও অরক্ষিত। ফলে যখন তখন ঢুকে পরছে মানুষ, পশুপাখি ও সাইকেল আরোহিরা। আলোর ব্যবস্থা না থাকায় রাতে কোনো উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারে না। ১৬০ দশমিক ৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিমান বন্দরের দুই তৃতীয়াংশের নিরাপত্তা প্রাচীর সঠিকভাবে নেই। ফলে সূর্যোদয় থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাষীরা ক্ষেতে কাজ করেন। গরু দিয়ে চাষ করেন। শস্য শুকানোর জন্যও বিমান বন্দরের জমি ব্যবহার করে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শিশুরা সাইকেল প্রশিক্ষণ করে থাকে। আবার গরুর জন্য ঘাসও কাটেন অনেকেই। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার অভাব সত্তে¡ও বরিশাল বিমানবন্দরে প্রতিনিয়ত যাত্রী ও ফ্লাইট সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ৩৪ বছর আগে নির্মিত এই বিমানবন্দরে বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান, বেসরকারি সংস্থা মিলিয়ে সপ্তাহে ১৪টি উড়োজাহাজ যাত্রী পরিবহন করছে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, আকাশ থেকে শস্যখেতে কীটনাশক ছিটানোর কাজে ব্যবহারের জন্য ১৯৬৩ সালে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে ‘প্ল্যান্ট প্রোটেকশন’ বন্দর হিসেবে দুই হাজার ফুট রানওয়ে নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৮৫ সালে এটিকে বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয়।
এরপর ১৯৯৫ সালের ১৭ জুলাই থেকে দিনের বেলা ঢাকা-বরিশাল রুটে বাণিজ্যিক বিমানের চলাচল শুরু হয়। বর্তমানে ১৬০ দশমিক ৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বরিশাল বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ছয় হাজার ফুট এবং প্রস্থ ১০০ ফুট। ১৯৯৫ সালে ফ্লাইট চলাচল শুরু হলেও এখনো আক্ষরিক অর্থে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও যে সব সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন তার ন্যূনতম এখানে গড়ে ওঠেনি। চালু হওয়ার ২৩ বছর পরেও নিরাপত্তার পাশাপাশি উন্নয়নের বিষয়টিও উপেক্ষিত। এখানে রানওয়ে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা নেই।
ফলে সন্ধ্যার আগেই বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলের দিকে কোনো ফ্লাইট বিলম্বিত হলে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। অনেক সময়ই পাইলটরা চরম ঝুঁকি নিয়ে রানওয়ে থেকে ফ্লাইট টেক অফ করাতে বাধ্য হন। আবার রানওয়ের সর্বত্র সিসি ক্যামেরা এবং পর্যাপ্ত মনিটর নেই।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, এই বিমানবন্দরে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নির্দেশনা অনুযায়ী রানওয়ে নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এই বিমান বন্দরে যে ধরনের উড়োজাহাজ (ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ মডেল) চলাচল করে তাতে রানওয়ের দৈর্ঘ্য হতে হবে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মিটার এবং প্রস্থ কমপক্ষে ৪৫ মিটার। কিন্তু এই বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ঠিক থাকলেও প্রস্থ মাত্র ৩০ মিটার-যা প্রয়োজনের তুলনায় ১৫ মিটার কম। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় দুটি রেসকিউ অ্যান্ড ফায়ার ফাইটিং (আরএফএফ) যান থাকলেও প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। এই বিভাগে ৮ জন কর্মীর স্থলে লোকবল আছে পাঁচজন।
আবার কন্ট্রোল টাওয়ারে চারজন লোকবলের স্থলে আছেন মাত্র একজন। বর্তমানে এখানে কর্মরত আছেন ৫৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে ২৪ জনই নিরাপত্তাকর্মী। এমন সীমাবদ্ধতার মাঝেই এই বিমানবন্দরে সপ্তাহে ১৪টি অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজ চলাচল করছে। জনবল সংকটের চিত্র সামনে এনে সঠিকভাবে দায়িত্বও পালন করছেন না অনেকেই। আর তা নিয়ন্ত্রন করতে পারছেন না ব্যবস্থাপক।