৯ ব্যাংকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

# ঘাটতির সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের
# জনতা ব্যাংকেরই ঘাটতি সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা

বিভিন্ন ছাড়ের পরও খেলাপি বাড়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংক খাত। বছর শেষে প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি নয়টি ব্যাংক। অংকে যার পরিমাণ ২২ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। তিন মাস আগে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ ছিল ১১ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদন মতে, গত ডিসেম্বর শেষে নয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫৭৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকরই ঘাটতি ১০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। তবে কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসাবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে পুরো ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। সার্বিকভাবে বাণিজ্যিক পুরো ব্যাংকে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার সাত কোটি ২৪ লাখ টাকা।

সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ (খেলাপি) ঋণে পরিণত হলে তাতে ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে যেন না পড়ে, সেজন্য প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে। বছর শেষে যেসব ব্যাংক প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সেসব ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে- রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড।

আলোচিত সময়ে নয় ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ঘাটতি ১৮ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডিসেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের চার হাজার ১১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের দুই হাজার ৬১৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

অন্যদিকে বেসরকারি পাঁচ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি চার হাজার ১৪৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩১৬ কোটি ১৮ লাখ, আইএফআইসি ব্যাংকের ২১২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২০৫ কোটি ১০ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের ১৪৯ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। আর বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি ৬ লাখ টাকা।

তথ্য বলছে, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ এক হাজার ৭৯৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। করোনার শুরুর বছর ২০২০-এর ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এসব খেলাপির মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোরই ছিল ৪৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ৫১ হাজার ৫২১ কোটি এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর দুই হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার খেলাপি হয়ে পড়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রের বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে তিন হাজার ৯৯১ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মতে, ব্যাংকের নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এরমধ্যে এসএমই বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ, আর ক্রেডিট কার্ডে রাখতে হয় সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ। তাছাড়া নিম্নমান (সাব স্ট্যান্ডার্ড) ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ (কুঋণ) ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়।

আলোচ্য সময়ে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮০ হাজার ৬৫৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬৬ হাজার ৬৪৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে পুরো ব্যাংকে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ১৪ হাজার সাত কোটি ২৪ লাখ টাকা।

ব্যাংকিং খাতে এমন নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম  বলেন, বারবার ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি বাড়ছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ় পদক্ষেপ এবং কঠোর আইনের ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার কাউকে যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ দেওয়াসহ সব দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে। যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ দিলে খেলাপি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক হয়েছে, এখন ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পাশাপাশি খেলাপি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও তৎপর হতে হবে। যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়ায়সহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার ফলে খেলাপি বাড়ছে। আবার নানা অজুহাতে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে গ্রহীতার মাঝে।