দেশের খেলাধুলার প্রধান ভেন্যু বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ভেতর-বাইরের চেহারাটা মোটেও শোভনীয় নয়। গ্যালারিতে এখানে সেখানে ভাঙা চেয়ার, ফুটবল মাঠের চারপাশের অ্যাথলেটিক ট্র্যাক জোড়াতালি দেয়া। মাঠের পানি নিষ্কাশন সিস্টেমও উন্নত নয়, বৃষ্টি হলেই জমে পানি। বর্ষা মৌসুমে খেলা হয় কাদা মাঠেই।
নিচে ভাঙা চেয়ার। উপরে খোলা আকাশ। কখনো রোদে গা পুড়ছে, কখনো বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শরীর। তারপরও মাঠে চোখ স্থির রেখে ফুটবল খেলা দেখছেন দর্শক। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে দর্শকদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না আর আড়াই থেকে তিন বছর পর। রোদ, ঝড়-বৃষ্টি যাই থাকুক না কেন, হোম অব ফুটবলের গ্যালারিতে বসে নির্বিঘ্নে খেলা দেখতে পারবেন সবাই।
২০২২ সালের জুনের মধ্যে নতুন রূপে দাঁড়াবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ৯৮ কোটি ৩৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা ব্যয়ে বদলে দেয়া হচ্ছে এই স্টেডিয়ামের চেহারা। স্টেডিয়ামের বিদ্যমান কাঠামো ঠিক রেখেই করা হবে সংস্কারকাজ। ‘ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের অধিকতর উন্নয়ন’- শীর্ষক প্রকল্পটি মঙ্গলবার অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
মাঠ উন্নয়ন, গ্যালারিতে শেড নির্মাণ, গ্যালারিতে চেয়ার স্থাপন, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুম আধুনিকায়ন, ফ্লাডলাইট স্থাপন, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, জেনারেটর স্থাপন, এলইডি জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো, নতুন অ্যাথলেটিক ট্র্যাক স্থাপন, ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বোর্ড স্থাপন, মিডিয়া সেন্টার তৈরি, টিকিট কাউন্টার, ডোপ টেস্ট রুম তৈরি, চিকিৎসা কক্ষ, ভিআইপি বক্স নির্মাণ, প্রেসিডেন্ট বক্স, টয়লেট উন্নয়ন, চিকিৎসা সরঞ্জাম, সাব-স্টেশন সরঞ্জাম, এসি ও সৌর প্যানেল সরবরাহ- এই কাজগুলো থাকছে স্টেডিয়াম সংস্কারে।
জন্মের পর বহুবার সংস্কার হয়েছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের। তবে প্রতিবারই সংস্কার হয়েছে কোনো আন্তর্জাতিক বা ঘরোয়া টুর্নামেন্ট সামনে রেখে। ২০১১ সালে আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে প্রায় ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয়েছিল এই স্টেডিয়াটির। ৮ বছর পর আরো বড় ধরনের সংস্কার হচ্ছে দেশের খেলাধুলার প্রধান এ ভেন্যুটি।
নির্দিষ্ট কোনো টুর্নামেন্ট উপলক্ষে এবার সংস্কার প্রকল্প হাতে নিচ্ছে না জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। বহুমাত্রিক ব্যবহৃত জাতীয় স্টেডিয়ামের বর্তমান অবস্থা সন্তোষজনক নয়। এখানে ফুটবল ও অ্যাথলেটিক ছাড়াও হয় জাতীয় পর্যায়ের নানা অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে দেশের খেলাধুলার প্রধান বলয়। গুরুত্ব বিবেচনা করেই সরকার এবার বড় ধরনের সংস্কার করতে যাচ্ছে জাতির জনকের নামের এই স্টেডিয়ামটি।
২০১৭ সালে যখন স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) তৈরি করেছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, তখন বাজেট ছিল ৮০ কোটি টাকার মতো। ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে সংস্কার শেষ করার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছিল ডিপিপি। কিন্তু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্টেডিয়াম সংস্কার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে। নতুন করে ডিপিপি তৈরি করার পর গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি)।
এই প্রকল্প সম্পন্ন হবে তিন অর্থবছরে। ২০১৯-২০, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ এই তিন বছরে ভাগ করা হয়েছে কাজ। সবচেয়ে বেশি টাকার কাজ হবে দ্বিতীয় অর্থবছরে। পরিমাণ ৫৭ কোটি টাকার মতো। প্রথম বছরে ২৬ ও শেষ বছরে ১৫ কোটি টাকার মতো। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। তবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, বছরভিত্তিক যে ব্যয় ধরা হয়েছে তাতে পরিবর্তন আসতে পারে কাজের সুবিধার্থে।
কোন কোন খাতে ব্যয় হবে ৯৮ কোটি ৩৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা? জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সুকুমার সাহা মঙ্গলবার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি, ২৩ কোটি টাকার মতো লাগবে গ্যালারিতে শেড বসাতে। অ্যাথলেটিক ট্র্যাক স্থাপনের জন্য খরচ হবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, প্রায় ২০ কোটি টাকা। প্রায় ১৫ কোটি টাকা লাগবে ফ্লাডলাইট স্থাপনে, গ্যালারিতে চেয়ার বসাতে লাগবে ১০ কোটি টাকার মতো। বড় খরচ এগুলোই।’
গ্যালারি ও ভিআইপিতে বসানো হবে উন্নতমানের নতুন চেয়ার। এর মধ্যে ভিআইপি গ্যালারিতে বসানো হবে ফোল্ডিং চেয়ার। বদলে ফেলা হবে স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইট। তবে ফ্লাডলাইটের টাওয়ার অপরিবর্তিত থাকবে। শুধু বদলে ফেলা হবে বাতি। প্রথমে এলইডি বাতি লাগানোর পরিকল্পনা ছিল। নতুন পরিকল্পনায় স্থাপন করা হবে জি-থ্রি ভারসনের বাল্ব। এর মাধ্যমে আলো ও সৌন্দর্য দুটিই বাড়বে।
স্টেডিয়াম সংস্কারের এত বড় সংস্কারকাজটি এমন সময় হতে যাচ্ছে যখন সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য খেলাধুলা নিয়ে করবে নানা আয়োজন। বঙ্গবন্ধুর নামে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হবে, ইউরোপের দুটি দল এনে প্রীতি ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনাও আছে বাফুফের। তাহলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কারকাজ হবে কীভাবে?
‘ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের অধিকতর উন্নয়ন’- শীর্ষক প্রকল্পটি মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দেয়ার পর যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল বলেছেন, ‘প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছে। এটা দেশের খেলাধুলার জন্য অনেক ভালো একটা খবর। এখন আমরা বসে কীভাবে কাজগুলো করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। আমাদের হাতে তিন বছর সময় আছে। যে কাজগুলো করলে খেলাধুলায় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না সেগুলো এখন করা হবে। যেমন গ্যালারিতে চেয়ার স্থাপন, ফ্লাড লাইট স্থাপন, ডিজিটাল জায়ান্ট স্ক্রিন তৈরি, মিডিয়া সেন্টার- এমন অনেক কাজ। মাঠ সংস্কার, অ্যাথলেটিক ট্র্যাক স্থাপন ও গ্যালারিতে শেড বসানোর কাজ হয়তো প্রথম দিকে ধরতে পারবো না।’
একনেকের অনুমোদনের চিঠিটি প্রথমে পরিকল্পনা কমিশনে যাবে। তারা একটি চিঠি দেবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অর্ডার পেলেই দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। আনুষ্ঠানিক কাজগুলো শেষ করে দরপত্র আহ্বান কারতে তিন-চার মাস লেগে যাবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সুকুমার সাহা।