#

সারা বছর বার্সেলোনায় যে মেসিকে দেখা যায় , এবারের বিশ্বকাপে সে মেসির দেখা মেলেনি এখনো। কোথায় সেই হরিণ চপলতা, চিতাসম ক্ষিপ্রতা, পায়ের জাদুকরি কারুকাজ আর আর প্রচন্ড ও তীক্ষ্ণ লক্ষ্যভেদী শটে একের পর এক গোল – ভক্তরা উন্মুখ অপেক্ষায় সেই মেসিকে দেখতে

কিন্তু অজনা কারণে মেসি কেন যেন নিষ্প্রভ, খানিক নিষ্পৃহ। কারো কারো মতে নিস্ক্রিয়ও। হয়ত কোচ সাম্পাওলির ফর্মেশন ও লাইন আপ তার স্বভাবসুলভ খেলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সহযোগীদের কাছে যা চাচ্ছেন, তা পাচ্ছেন না। কিংবা কোন কারনে চিত্তটাও হয়ত প্রফুল্ল নয়। অন্য সময় মানে ক্লাব ফুটবলে যতটা উদ্যমী আর ভিন্ন কিছু করতে যতটা উদ্যোগী মনে হয় – এবারের বিশ্বকাপে কেন যেন সেই তেড়েফুড়ে কিছু করার মানসিকতাই নেই! কোথায় যেন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। তাই হয়ত নিজের সেরাটা সেভাবে দিতে সমস্যা হচ্ছে মেসির।

আরেক নামীদামি তারকা নেইমারের অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। খুব ভালভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে শতভাগ ফিট নন। ইনজুরি কাটিয়ে সবে মাঠে নামার কারনেই হয়ত ঠিক ছন্দে নেই। যা করতে চাচ্ছেন তার অনেক কিছুই হচ্ছেনা। যে বল তার কথা শোনে, এখন পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড ও কোষ্টারিকার বিপক্ষে সেই বল কথা শোনেনি। সেই দ্রুত গতিতে প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগে চির ধরানো ড্রিবল, বডি ডজ কোনটাই পারফেক্ট হচ্ছেনা। শ্যুটিংয়ের অবস্থাও বিশেষ ভাল না। বেশীর ভাগ শটের লক্ষ্য-নিশানাও ঠিক নেই।

অন্য সময় যা করে সফল হন, সেই কাজ মানে একটু বেশী সময় পায়ে বল রেখে প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগকে ব্যতিব্যস্ত রাখার পাশাপাশি ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছেন। যা পজিটিভের চেয়ে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলছে বেশী। বেশীর ভাগ সময় তা যথাযথ হচ্ছেনা। বলের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। তা থেকে হচ্ছে কাউন্টার অ্যাটাক।

কেন মেসির মত মাস্টার ড্রিবলার, তুখোর বল প্লেয়ার, প্লে মেকার ও দক্ষ স্কোরার নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন না, কি কারণে নেইমার আলো ছড়াতে পারছেন না ?তা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন চলছে। ফুটবল পন্ডিতরা কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

বাংলাদেশের ফুটবল বিশেষজ্ঞ ও সাবেক ফুটবলাররাও নিজের মত করে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চিত্র সম্পুর্ণ উল্টো। এখানে যুক্তি-তর্ক এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনের বালাই নেই। প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টাই নেই। তার বদলে আছে হালকা ও চটুল কথা বার্তা।

ফেসবুক ভরে গেছে রাজ্যের সস্তা সংলাপে। সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার বদলে হালকা চটুল আর সস্তা কথোপকথন এসে বাসা বেধেছে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পারফরমেন্স নিয়েও নানা কটাক্ষ, ব্যঙ্গক্তি।

আসরটা বিশ্বকাপ, নামেই ‘বিশ্ব’ আসর। এখানে যারা খেলতে এসেছে, তারা কেউই দূর্বল নয়। গত দুই তিন বছর অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এখানে এসেছে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে মাঠে নামেনা।

কিন্তু একটা সমস্যা হয়ত হচ্ছে। তাহলো অতিমাত্রায় স্প্যানিশ, ইংলিশ, ইতালিয়ান, ফরাসী আর জার্মান লিগ অনুসরণ করায় ঐ লিগগুলোর ভাল পারফরমারদের দিকেই সবার চোখ। কিন্তু এর বাইরেও যে মেধাবি ফুটবলার থাকতে পারে, তারা লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর নেইমার মানের না হলেও বিশ্বকাপের মাঠ গরম করে তুলতে পারে, নৈপুণ্যের আলোকছটায় প্রতিপক্ষকে ম্লান করে দিয়ে নিজ দলের জয়ের কেতন ওড়াতে সক্ষম- এমন চিন্তাও গেছে কমে।

আর তাই আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, রাশিয়া, বেলজিয়াম আর কোষ্টারিকার ফুটবল সামর্থ্যের প্রতি সে অর্থে শ্রদ্ধা কমই। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ ফুটবল অনুরাগী যেহেতু আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল সমর্থক- তাই তাদের বড় অংশের ভাবটা এমন, আরে বাকিরা সব বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করবে।

তা কি হয়? ঐসব দলওতো খেলতে এসেছে। তাদেরও একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে। এখন তাদের সাথে খেলতে গিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ঘাম ঝড়েছে । ঝড়তেই পারে। তাই বলে ঐ দলগুলো কেন বেশী ভাল খেলছে, হলুদ আর সাদা-আকাশী জার্সির দিন ফুরিয়ে গেছে- এমন ভাবারও কোন মানে নেই।

নির্জলা সত্য হলো ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ সম্ভাবনা শেষ হয়নি এখনো। ব্রাজিলের সেরা ১৬’তে পা রাখার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। শেষ ম্যাচে সার্বিয়ার সাথে ড্র করলেই চলবে । আর একই ভাবে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার পথ বন্ধ হয়নি। নাইজেরিয়াকে শেষ খেলায় হারাতে পারলেই শীর্ষ ষোলোয় পা রাখবে মেসির দল।

মানছি, দু’দলের কেউই প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি। নিজেদের সেরা খেলাটা খেলা সম্ভব হয়নি। এটা হতেই পারে। তাই বলে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল যে জ্বলে উঠতেই পারবেনা, তাদের বিশ্বকাপ সম্ভাবনার প্রদীপ সলতে হয়ে নিভু নিভু করছে, এমন ভাবা বোধ করি ঠিক হবেনা।

বিশ্বকাপের ইতিহাসও তা বলেনা। বেশী দুর পিছন ফিরে তাকাতে হবেনা। ঠিক তিন যুগ আগের কথা। ১৯৮২ সালে স্পেনে বসা বিশ্বকাপের ১২তম আসরের দিকে তাকাই আসুন।

সবার জানা পাওলো রোসির চমক জাগানো নৈপুন্যে হট ফেবারিট ব্রাজিলের স্বপ্ন ভেঙ্গে বিশ্বকাপ জিতেছিল ইতালি। শুনে অবাক হবেন! প্রথম পর্ব মানে গ্রুপপের খেলায় ইতালিকে কেউ পাত্তাই দেয়নি। কোন হিসেবেই ছিলনা আজ্জুরিরা। ব্রাজিল যখন প্রথম পর্বে গোলের তুবরি ছোটাচ্ছিল, ইতালি তখন পোল্যান্ড, ক্যামেরুন আর পেরুর মত মধ্যম সারির দলগুলোর সাথে প্রানপণ লড়ছে।

গ্রপ পর্বে ঐ তিন দলের বিপক্ষে ম্যাচে জয়ের দেখা মেলেনি। তিনটি ম্যাচই ড্র করেছিল ইতালি। সাকুল্যে দুটি গোল করেছিলেন ইতালিয়ানরা। আর দুটি গোল হজমও করতে করতে হয়েছিল। তার মানে স্বপক্ষ আর বিপক্ষ গোলের হিসেব নিকেশে ইতালির হাতে কোন গোল ছিলনা।

সমান তিন ম্যাচে ইতালির মত সব ম্যাচ অমিমাংসিত রেখে তিন পয়েন্ট পেয়েছিল আফ্রিকার ক্যামেরুনও। সৌভাগ্য ইতালির। তারা দুই গোল করে সমান দুই গোল হজম করেছিল। আর ক্যামেরুন দিয়েছিল একটি মাত্র গোল। খেয়েওছিল এক গোল। তাদেরও হাতে কোন গোল ছিলনা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যা হয়, মানে শ্রেয়তর গোল ব্যবধান নির্ধারনে বেশী গোল করা দলকে এগিয়ে থাকে। ইতালি সেই হিসেবে পোল্যান্ডের মত দ্বিতীয় দল হিসেবে ক্যামেরুনকে টপকে দ্বিতীয় পর্বে উঠে আসে। তারপরের ইতিহাস সবার জানা।

সেই গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচে চরম অনুজ্জ্বল ইতালিই দ্বিতীয় পর্বে আগের বারের ( ১৯৭৮ সালের ) বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ( ২-১) আর হট ফেবারিট জিকো-সক্রেটিসের ব্রাজিলের (৩-২) বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান করে দিল।

সেরা ষোলোর লড়াইটাও ছিল গ্রুপ পর্বে। অথচ গ্রুপ পর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্কটল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সবকটিতে জিতে আর ১০ গোল করে সে পর্বে উঠে আসা ব্রাজিল, খুরিয়ে খুরিয়ে উঠে আসা ইতালির কাছে করুণভাবে হেরে বিদায় নিয়েছিল। আর সেমিতে পোল্যান্ড (২-০) ও ফাইনালে জার্মানীকে (৩-১) হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে বিশ্বকে চমকে দিল রোসির ইতালি।

এবারো তেমন কিছু ঘটবেনা, এখন পর্যন্ত গ্রুপ পর্বে নিজেদের মেলে ধরতে না পারা কোন দল যে শেষ হাসি হাসবেনা- তা কি করে বলা যায়?

এখন পর্যন্ত নিজেদের সামর্থ্যের সেরাটা খেলতে না পারা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের কেউই শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হবেনা, সারা বছর ফুটবল নিয়ে মাথা ঘামান, চুল-চেরা বিশ্লেষন করেন আর বিশেষজ্ঞ মতামত দেন- এমন কেউ বুকে হাত দিয়ে তা বলতে পারবেন? চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবেন?

পারবেন না। কারন ক্রিকেটের মত ফুটবলের গায়ে হয়ত অনিশ্চয়তার কাঁটা নেই। কিন্তু ফুটবলেও ওঠা নামার পালা চলে নিরন্তর। কেউ গ্রুপ পর্বে ও দ্বিতীয় পর্বে দারুণ খেলে নক আউট পর্বে গিয়ে খেই হারিয়ে সর্বশান্ত হয়। আবার কোন দল কোনরকমে খুরিয়ে খুরিয়ে গ্রুপ পর্ব শেষ করে সময়ের সাথে সাথে মাথা তুলে দাড়ায়। ধীরে ধীরে নৈপুণ্যের দ্যুতিতে মাঠ আলোকিত করে। এক সময় শেষ হাসি হাসে।

এটা সত্য যে, মেসির আর্জেন্টিনা আর নেইমারের ব্রাজিল এখন পর্যন্ত দর্শক ও সমর্থকদের প্রত্যাশা পুরণ করতে পারেনি। তাই বলে যে একদমই পারবেনা, শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে দেশে ফিরবে- তাইবা কি করে বলা?

উত্তর দিন

Please enter your comment!
এখানে আপনার নাম লিখুন