৭৭ বছর বয়সে এসএসসির ছাত্রী সাজেদা বেগম

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

সাজেদা বেগম। একটি অনুপ্রেরণার নাম। অদম্য এক নারী। প্রায় ৭৭ বছর বয়সী বৃদ্ধা তিনি। বুক ভরা স্বপ্ন, দৃঢ়চেতা আর সাহস-ই তাঁর সঞ্জীবনী শক্তি। দৃষ্টিশক্তির অস্পষ্টতা, শারীরিক অসুস্থতা কিংবা বয়সের ভার কোনো কিছু রুখতে পারেনি তার পথচলা।

 

শুক্রবার (৪ আগস্ট) বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা আঞ্চলিক কেন্দ্রে এসএসসি ভর্তি পরীক্ষার হল পরিদর্শনকালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার দেখতে পান সাজেদা বেগমকে। ‘বাউবির দীক্ষা: সবার জন্য উন্মুক্ত কর্মমুখী, গণমুখী ও জীবনব্যাপী শিক্ষা’— স্লোগান সামনে রেখে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম/জেএসসি বা সমমানের সনদ নেই যাদের, তাদের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এসএসসি গ্রোগামে ভর্তির সুযোগ করে দেন। দেশব্যাপী সাজেদা বেগমের মতো সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষাবঞ্চিত আগ্রহী শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের পথ উন্মুক্ত হয়।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগে জন্ম তাঁর। আরও স্পষ্ট করে বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। বর্তমান এয়ারপোর্ট ১ নম্বর টার্মিনালে ছিল তাদের আদি বাড়ি। নবাব হাবিবুল্লাহ গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন সাজেদা বেগম। স্কুলের গণ্ডি পেরুতে না পেরুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের ইয়ং অফিসার আবুল হাসেমের সঙ্গে। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট, বাস্তবতায় অষ্টম শ্রেণীতেই খাঁচাবন্দী হয় সাজেদা বেগমের স্বপ্ন। এরপর কোলজুড়ে বড় মেয়ে হাসিনা আখতার, ছেলে মাসুদ রানা ও মাসুম রেজা আসে। হাড়ভাংগা শ্রম আর স্বপ্ন লালন করে মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি করান। বর্তমানে তিনি সোনালী ব্যাংকের এজিএম। মাসুদ রানা কম্পিউটার সায়েন্সে জার্মান থেকে উচ্চতর ডিগি নেন। আর মাসুদ রেজা উচ্চ শিক্ষা শেষ করে ব্যবসা করছেন।

 

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির খবর পেলেন কীভাবে জানতে চাইলে সাজেদা বেগম বলেন, ‘‘একদিন ছোট ছেলে একটা পত্রিকা নিয়ে এসে বলল ‘দ্যাখছো মা কিশোরগঞ্জের বাউবি’র এই ছেলে চা বিক্রি করে এসএসি পাস করছে, তোমার তো লেখাপড়ায় খুব আগ্রহ, তুমিও পরীক্ষা দাও। আমরা তোমার লগে আছি।’ সেই দিন থেকে বড় মেয়ের সঙ্গে বাউবিতে আসা-যাওয়া। প্রথমে লজ্জা লাগলেও পরে দেখি, সব বয়সের নারী পুরুষ, ডাক্তার, চাকরীজীবী, সচিব, পুলিশ, আর্মি, শারীরিক প্রতিবন্ধী সবাই এখানে বিভিন্ন প্রোগামে পড়াশোনা করে। আমার মনে শক্তি জাগল। ছোট ছেলে ও নাতি মোবাইলে ইন্টারনেটে দেখিয়ে দিল কীভাবে ক্লাস হয়, কী কী বিষয় পড়তে হয়। ভর্তি, টাকা জমা, নোটপত্র, বই সব মোবাইলে। সব কিছু এত সহজ হয়ে গেল যে, মনে হল যেন বুক থেকে পাহাড় সরে গেল।’’

জীবন সায়াহ্নে এসে কী স্বপ্ন দেখেন আপনি— এমন প্রশ্নের জবাবে সাজেদা খাতুন বলেন, ‘আমি অনেকদূর পড়াশোনা করতে চাই। আল্লাহ বাঁচায়ে রাখলে বাউবি থেকে এসএসসি, এইচএসসি পাস করে নকঁশী কাথা নিয়ে কাজ করে এমন একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একদিন আমি ভর্তি হব।’

 

বাউবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘সাজেদা বেগম সাহসের নাম। একজন অনন্যা, অপরাজিতা। শিক্ষাবঞ্চিত নারীদের আদর্শ। এদেশে অসংখ্য নারী আছেন মেধাবী কিন্তু সামাজিক, পারিবারিক চাপে বিয়ের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। বাউবির শিক্ষাক্রম সব সময় তাদের পাশে। আমরা সারা দেশে সকল বয়সের, পেশার নাগরিকের ঘরে বসে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছি। এমন কী সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, দুবাই, ইতালিতে অবস্থানরত বাঙালি রেমিটেন্স যোদ্ধারা সেখানে বসে এখন বাউবির বিভিন্ন প্রোগামে শিক্ষা গ্রহণ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পটুয়াখালীর সাগরপাড়ের জেলে হাসান শেখ, কিশোরগঞ্জের চা বিক্রেতা হারুন মিয়া, বগুড়ার হুইল চেয়ারের যোদ্ধা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নুরজাহান রিয়া কিংবা নারী সাফ ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন, মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ফটোগ্রাফার নিজামুল বিশ্বাস— এরা সবাই বাউবির স্টুডেন্ট। সব মিলিয়ে দক্ষতা, শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ও আলোকিত মানুষ গড়তে বাউবি আজ একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান।’