বয়স যখন আট বছর তখন থেকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য বাবার সঙ্গে দিনমজুরি শুরু করেন দানা মিয়া। পেটের দায়ে মাটিকাটা আর রাজমিস্ত্রির কাজের মতো বিভিন্ন কায়িক শ্রমের কাজ করেন দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে।
দিনমজুরি করে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। অথচ ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি আজও। এখন দানা মিয়ার বয়স ৪৫ বছর। এখনও দিনমজুরি করেই সংসার চলছে তার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের দারমা গ্রামের বাসিন্দা দানা মিয়া অর্থের অভাবে পড়ালেখা করতে পারেননি। দরিদ্র বাবা জালাল উদ্দিনের তেমন সহায়-সম্পদও ছিল না। বাধ্য হয়ে তাকে দিনমজুরিতে নামতে হয়।
স্ত্রী আর সাত ছেলে-মেয়ে নিয়ে দানা মিয়ার ৯ সদস্যের পরিবার। এত বড় সংসারের জন্য নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার। একজনের সামান্য আয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়ায় বড় ছেলে ফারুক মিয়াকেও (১৫) নিজের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। তবুও অভাব দূর হয় না দানা মিয়ার পরিবারের। সপ্তাহে ছয় দিন শাক-সবজি আর একদিন খান মাছ-ভাত। বছরে মাত্র এক-দুবার জোটে মাংস-ভাত।
দানা মিয়ার কাছ থেকে তার দুঃখভরা জীবনের গল্প শুনেছেন এই প্রতিবেদক। সেই গল্পের পরতে পরতে কেবলই অভাব-অনটন আর অনিশ্চয়তা। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন দানা মিয়া। সেই ঘরের এক অংশে আবার গোয়ালঘর।
দানা মিয়া বলেন, আমার বাবার তেমন কোনো সহায়-সম্পদ ছিল না। টাকার অভাবে আমরা চার ভাই-বোনের কেউই পড়ালেখা করতে পারিনি। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই বাবা আমাদের কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে মানুষের জমিতে কাজ করতাম, মাটি কাটতাম। ছোটবেলায় যে কাজ শুরু করেছি, তা আজও করে যাচ্ছি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারের দুঃখ-কষ্ট বেড়ে যায়। টানাপোড়েনের সংসারে জীবনে কখনও ভালো খাবার খেতে পারিনি আমরা।
তিনি বলেন, জীবিকার তাগিদে ভোরবেলা কাজের সন্ধানে বের হই। কারণ কাজ না করলে ঘরে চুলা জ্বলবে না, স্ত্রী-সন্তান না খেয়ে থাকবে। যখন যে কাজ পাই সেই কাজই করি। ধানের মৌসুমে মানুষের জমির ধান লাগাই। অন্য সময়ে রাজমিস্ত্রি, মাটি কাটাসহ বিভিন্ন কাজ করি। এসব কাজ করে দিনে ২০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পাই। এই টাকা দিয়ে তো সবদিন ভালো খাবার খাওয়া যায় না। তাই বছরে এক-দুবার মাংস-ভাত খাই। বাকি দিনগুলো শাক-সবজি খেয়ে কাটিয়ে দেই। ছেলে-মেয়ের জন্য খুব কষ্ট হয়। টাকার অভাবে নিজে লেখাপড়া করতে পারিনি, এখন আমার ছেলে-মেয়েদেরও লেখাপড়া শেখাতে পারছি না। বাবা হিসেবে নিজেকে খুব ব্যর্থ মনে হয়।
তিনি আরও বলেন, জীবনের অর্ধেক সময় পার করে দিলাম দিনমজুরি করে। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটন দূর করতে পারলাম না আজও। একজনের আয়ে এত বড় সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। সেজন্য বছর দেড়েক ধরে বড় ছেলে ফারুকও আমার সঙ্গে দিনমজুরি করছে। দুজন মিলে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা মজুরি পাই। ছেলেটার জন্য খুব মায়া হয়। আমার ভবিষ্যৎ তো আমি গড়তে পারিনি। এখন ছেলেটাকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিলাম। বই-খাতার বদলে ছেলেটার হাতে মাটি কাটার কোদাল তুলে দিয়েছি।
দানা মিয়ার স্ত্রী হালিমা বেগম বলেন, অভাব-অনটনের সংসারে ছেলে-মেয়েদের ভালো-মন্দ খাওয়াতে পারি না। পড়ালেখাও করাতে পারছি না টাকার অভাবে। আগে আমার স্বামী দিনমজুরি করতো, এখন অভাবের কারণে ছেলেও দিনমজুরি করছে। এই বাচ্চা ছেলের কামাইয়ে সংসার চালাতে হয়। মা হয়ে ছেলে-মেয়েদের এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।
দারমা গ্রামের মুরুব্বি বাশার সরকার বলেন, দানা মিয়ার বাবাকেও দেখেছি দিনমজুরি করতে। এখন দানা মিয়াও দিনমজুরি করছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যখন কাজ-কর্ম একেবারে থাকে না তখন খুব কষ্টে দিনযাপন করে তারা। আমরা পাড়া-প্রতিবেশী হিসেবে যতটুকু পারি তাদের সহযোগিতা করি।
মজলিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, দারমা গ্রামের ৬০ শতাংশ মানুষ দিনমজুরি করেন। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সবাইকে সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করেছি। দানা মিয়াকেও আমরা সহযোগিতা করব।
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com