ঢাকার চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদ। এগুলো হচ্ছে ঢাকার ‘লাইফ লাইন’। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সুরক্ষিত নাগরিক সভ্যতা হিসেবে ঢাকাকে গড়ে ওঠার মূলে এ চার নদ-নদীর ভূমিকা অপরিসীম। অথচ মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সব উপযোগিতাই হারিয়ে ফেলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নে এসব নদীর পানি স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়েছে। সেই সঙ্গে অবাধে চলেছে নদী ভরাট, অপদখল এবং নদী বিনাশী নানা তৎপরতা।
অনেক দেরিতে হলেও দেশের সর্বোচ্চ আদালত ঢাকার ওই চার নদ-নদীর সুরক্ষা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং এর ভূমি পুনরুদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ‘ঢাকাসহ সারাদেশের নদ-নদী নিয়ে আর কানামাছি খেলা যাবে না’- এমন মন্তব্যও করেন হাইকোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহ থেকেই গত ২৯ জানুয়ারি থেকে নদীরক্ষায় শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। এটি এখনও অব্যাহত আছে।
‘নদীর তীর দখলরোধে উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে’ জানিয়ে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ বজায় থাকবে বলে ঘোষণা দেন। প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ আদালতের নির্দেশনার আলোকেই পরিচালিত হবে।
তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা। ১০ জানুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বেশকিছু জনহিতকর কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। বিগত ১০০ দিনে এ মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে আলোচিত কাজ নদীর পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম।
মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিগত ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার উচ্ছেদ অভিযান এখনও চলমান। বিরতি দিয়ে চলমান উচ্ছেদ অভিযানে প্রায় তিন হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছে ৭১ একর জায়গা।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা যায়, গত ২ জানুয়ারি নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঁচ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়। মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে আহ্বায়ক করে গঠিত এ ওয়ার্কিং গ্রুপ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, এসডিজি বাস্তবায়ন কৌশল ২০৩০, সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ), অবকাঠামো উন্নয়নে বৃহৎ প্রকল্পসহ (মেগা প্রজেক্ট) সংশ্লিষ্ট দলিলগুলো পর্যালোচনা ও বিবেচনায় নিয়ে অ্যাকশন প্ল্যান প্রস্তুতের লক্ষ্যে কাজ করবে।
৩ হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, ৭১ একর ভূমি অবমুক্ত
উচ্ছেদ কার্যক্রম থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিআইডব্লিউটিএ নদীর তীর দখলমুক্ত করতে ২৯ জানুয়ারি হতে ২৮ মার্চ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর কামরাঙ্গীরচর হতে ধারাবাহিকভাবে তুরাগ নদের মিরপুর বেড়িবাঁধের গড়ান চটবাড়ি পর্যন্ত মোট ২২ কিলোমিটার এলাকায় দুই হাজার ৮৪৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। এ সময়ে এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা, ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকার নিলাম এবং ৬১ একর জায়গা অবমুক্ত করে।
এছাড়া ৮ থেকে ১১ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি ও মীরকাদিম এবং ঢাকার রূপনগর ও সাভার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিআইডব্লিউটিএ। অভিযানে মোট প্রায় ১৪০টি অবৈধ স্থাপনা ও চারটি বালুর গদি উচ্ছেদ করা হয় এবং প্রায় ১০ একর তীরভূমি অবমুক্ত করা হয়।
উচ্ছেদ অভিযান গতিশীল করতে সমন্বিত উদ্যোগ
চলমান উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে ১০ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ঢাকার চারপাশের নদীর তীর দখল ও দূষণরোধে বিআইডব্লিউটিএ, সিটি কর্পোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করার সিধান্ত গৃহীত হয়।
বাংলাদেশ-ভারত পর্যটকবাহী জাহাজ চালু
প্রায় ৭০ বছর পর বাংলাদেশ থেকে ভারতে পর্যটকবাহী জাহাজ চালুর বিষয়টি এ সময়ে বেশ আলোচনায় আসে। গত ২৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের পাগলা মেরিএন্ডারসন জেটি থেকে কলকাতার উদ্দেশে ছেড়ে যায় যাত্রীবাহী জাহাজ এমভি মধুমতি। গত ৬ এপ্রিল কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ‘আরভি বেঙ্গল গঙ্গা’ পৌঁছায় নারায়ণগঞ্জের পাগলা মেরিএন্ডারসন জেটিতে। এর মাধ্যমে নতুন করে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ক্রুজ শিপ চালু হয়।
নদীগুলোর প্রবাহমান ধারা ফেরানোর উদ্যোগ
খননের মাধ্যমে সারাদেশের নদীগুলোর প্রবাহমান ধারা ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ যে একটি নদীমাতৃক দেশ তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরা হবে। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এসব নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে খনন কাজ শুরু হবে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তা কামনা
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘বাংলাদেশ রিজিওনাল ওয়াটারওয়ে ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প-১’ এবং ‘বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রকল্প-১’ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী দেশের নৌপথ ও স্থলবন্দরগুলো আরও গতিশীল করতে নদী খনন কার্যক্রমে সহায়তা দিতে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
পায়রা বন্দরের উন্নয়নে পরামর্শক নিয়োগ
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পায়রা বন্দরের উন্নয়নের লক্ষ্যে সঠিক কৌশলগত পরিকল্পনা ও ডিটেইল মাস্টার প্লান প্রণয়নের জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হলো-নেদারল্যান্ডের রয়েল হাসকনিং ডিএইচভি ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্বদ্যিালয়ের গবেষণা, পরীক্ষা ও পরামর্শক ব্যুরো (বিআরটিসি)। ১৪ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পরামর্শক নিয়োগ-সংক্রান্ত একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
বাংলাদেশ-কোরিয়ার মধ্যে সমঝোতা স্বাক্ষর
গত ১ এপ্রিল বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বন্দর ও এর আওতাধীন এলাকা উন্নয়নে দ্বি-পাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারকপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুস সামাদ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে মহাসাগর ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার কিম ইয়াং সু স্বাক্ষর করেন।
সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা
দ্রুত পণ্য খালাস ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম আরও সহজতর ও বাস্তবমুখী করার লক্ষ্যে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট স্থানের ব্যাংক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গত ৬ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম, মোংলা ও স্থলবন্দরগুলোর কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনিষ্পন্ন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক হয় এবং সেগুলো নিষ্পত্তি করা হয়।
৪১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৫টি প্রকল্প
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই হাজার ৮৫৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ভুক্ত ৩৫টি এবং এক হাজার ৩১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এডিপির সভায় এসব তথ্য জানানো হয়।
জাহাজ (সুরক্ষা) আইন ২০১৯ এর খসড়া অনুমোদন
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন ২০১৯-এর খসড়া গত ২৮ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে সমুদ্রপথে পরিবাহিত পণ্যের অন্যূন শতকরা ৫০ ভাগ পণ্যাদি বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে পরিবাহিত হবে। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ বলতে বাংলাদেশে নিবন্ধিত সমুদ্রগামী সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রকার জাহাজকে বোঝায়। বর্তমানে বাংলাদেশে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৪৪টি। এর মধ্যে ছয়টি সরকারি এবং ৩৮টি বেসরকারি।
২৬টি জাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ
চীন থেকে তিনটি জাহাজ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) বহরে যুক্ত হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে যুক্ত হয়েছে আরও তিনটি। আরও ছয়টি নতুন জাহাজ সংগ্রহের সরকারি অনুমোদন পাওয়া গেছে। বিএসসি আরও ২০টি জাহাজ সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। গত ২০ জানুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিএসসির ৩০০তম পরিচালনা পর্ষদের সভায় এসব তথ্য জানানো হয়।
পায়রা বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং
পায়রা বন্দরে অধিক ড্রাফটের জাহাজ আনাসহ পূর্ণাঙ্গরূপে এটি চালুর লক্ষ্যে রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পায়রা ড্রেজিং কোম্পানি লিমিটেড গত ১৪ জানুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি পিপিপি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে।
পুরোদমে পরিচালিত হবে পানগাঁও আইসিটি
ঢাকার পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) পুরোদমে পরিচালিত হবে বলে ঘোষণা দেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ ঘোষণা দেয়া হয়।
নদী দখল-দূষণের অভিযোগের জন্য হটলাইন চালু
গত ১২ ফেব্রুয়ারি যাত্রী হয়রানি, নদী দখল-দূষণ সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে হটলাইন চালু করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিআইডব্লিউটিএ।
নিজস্ব প্রধান কার্যালয়
দীর্ঘ ১৭ বছর পর গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্বোধন করেন নৌ-পরিবহন সচিব মো. আব্দুস সামাদ।