৩৪ বছরের শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে পত্রিকা বিলি করেন তিনি। কোনও আর্থিক অনটনের কারণে নয়, একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের মাঝে তথ্য জ্ঞান পৌঁছে দিতে তার এই প্রয়াস। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটেসহ বিভিন্ন যানবাহনে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ ঘুরে ৩শ’ কপি পত্রিকা বিক্রি করেন তিনি।
শুধু অর্থ কামাই নয়, যারা ছোট কাজ করতে অপমানিত বোধ করেন, যারা কাজ করতে লজ্জা পান সেই সব নতুন প্রজন্মের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতেই এই কাজ বেছে নিয়েছেন তিনি। এই দৃষ্টান্ত অনুকরণ করে কেউ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হলেই তবেই স্বার্থকতা খুঁজে পাবেন বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজের রসায়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী ইসাহাক শরীফ।
কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন বরিশাল জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদক। ২০১৬ পর্যন্ত জেলা কমিটিতে ছিলেন ইসাহাক শরীফ। কিন্তু পার্টির নেতৃত্বে নাখোশ হয়ে ২০১৬ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিপিবি) যোগ দেন তিনি। বর্তমানে তিনি সিপিবি বরিশাল জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
ওয়ার্কার্স পার্টিতে থাকাকালে সংগঠনের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘নতুন কথা’ দলের কর্মী এবং পাঠকদের মাঝে পৌঁছে দিতেন। ১৯৮০ সালে নতুন কথা প্রকাশের পর থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দলের মুখপত্র বিলি করেন তিনি। এই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে কলেজ শিক্ষকতা থেকে অবসরের পর ২০১৬ সালের ১ মে থেকে জ্ঞানের ফেরিওয়ালা (হকার) বনে যান তিনি।
হকারি জীবনের শুরুতে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত মহল ইসাহাকের এই কাজটি তুচ্ছজ্ঞান করেননি বটে, তবে তারা বিভিন্নভাবে তার হকারি কাজে বাঁধ সাধেন। স্ত্রী, একমাত্র শিক্ষিকা মেয়ে এবং মেঝভাই তার হকারির বিরুদ্ধে জোড়ালো প্রতিবাদ করে। তবে ইসাহাক শরীফ এসব নিয়ে কারও সাথে বিতর্কে যাননি। তার বক্তব্য, আমার একটা লক্ষ্য আছে, তারা (আত্মীয়-স্বজন) তো সেটা ফেলে দিতে পারে না।
তাদের অনেকেই তাকে বলেছেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এই কাজটি মানানসই নয়। বিশেষ করে তার (ইসাহাক) জন্য উপযুক্ত নয় এবং আর্থিক সমস্যা নেই বলে স্বজনরা তাকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। হকার হওয়ার পর কিছু মানুষ, এমনকি সাবেক কিছু ছাত্ররাও তাকে এড়িয়ে চলেছে।
শুরুর দিকে তিনি দেড় শ’ কপি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা বিক্রি করতেন। এখন জাতীয় ও স্থানীয় মিলিয়ে প্রায় ৩শ’ কপি পত্রিকা বিলি করেন প্রতিদিন।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে হকারি কাজ শুরু হয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ইসাহাক শরীফের। পায়ে হেটে ১৫-২০ কিলোমিটারসহ বিভিন্ন যানবাহনে বাবুগঞ্জের কেদারপুরের পূর্ব ভূতেরদিয়া থেকে বাহেরচর, রাকুদিয়া, রহমতপুর, ৭ মাইল ক্যাডেট কলেজ এবং উজিপুরের গুঠিয়া এলাকার প্রায় ৮০ কিলোমটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন গ্রাহকদের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেন তিনি। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়, শৈত্য প্রবাহ কোনও কিছুই ইসাহাকের হকারি কাজে বাঁধ সাধতে পারেননি। হকারি করে কমিশনে প্রতিদিন প্রায় ৪শ’ টাকা আয় করেন তিনি। কিছু টাকা আজীবন বাকি থেকে যায়। গত মে মাসে ১৩ হাজার, জুনে ৬ হাজার, জুলাইতে ৭ হাজার, আগস্টে ৮ হাজার এবং সেপ্টেম্বরেও ৮ হাজার টাকা আয় হয়েছে তার।
আয়ের একটি অংশ শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় করেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে গিয়ে ‘পড়ুন শিখুন, জীবন গড়ুন’ বলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করেন তিনি।
এখন থেকে যেসব এলাকায় পত্রিকা দেন সেইসব এলাকার প্রাইমারি থেকে কলেজ পর্যায়ের মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ক্রেস্ট না দিয়ে নগদ টাকা পুরস্কার দেওয়ার মনস্থির করেছেন ইসাহাক শরীফ।
এর আগে ২০১৭ সালের ৩ মে পত্রিকা বিলি করতে যাওয়ার সময় সদর উপজেলার গড়িয়ারপাড় বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক পাড় হতে গিয়ে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ডান পা ভেঙে যায় তার। ৭ মাসে কিছুটা সুস্থ্য হওয়ার পর একই বছরের পহেলা ডিসেম্বর আবারও ক্রাচে ভর দিয়ে হকারি শুরু করেন তিনি।
ইসাহাক শরীফ বলেন, উন্নত দেশে সবাই কাজকে সন্মান করে। এদেশে কাজের শ্রেণি বিন্যাসে যুবকরা পরিশ্রম বিমুখ। তারা পরিশ্রমের কাজকে হেয় মনে করে এবং এ কারণে তারা কাজ পায় না। তারা বেকারত্বের মধ্যে নেশায় মত্ত হয়। আর্থিক অস্বচ্ছলতা না থাকার পরও তাদের কাছে উদাহরণ সৃষ্টির জন্য এই কাজ চালাচ্ছেন তিনি। এটা তাদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কুলি হয়েছিলেন। সেটা আমরা স্বীকার করি, কিন্তু অনুসরণ করি না। ইসাহাক শরীফকে দৃষ্টান্ত তুলে ধরে মুরুব্বিরা নতুন প্রজন্মকে উদাহরণ দিক সেটাই প্রত্যাশা তার।
বাবুগঞ্জের রাকুদিয়া গ্রামের কৃষক আবুল কালাম শরীফ ও গৃহিনী জামেনা খাতুন দম্পত্তির ছেলে ইসাহাক শরীফ ১৯৬৩ সালে বানারীপাড়ার চাখার ফজলুল হক স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ৪ ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ইসাহাক চাখার ফজলুল হক কলেজ থেকে ৬৮ সালে এইচএসসি পাশ করার পর পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়েন। ৪ বছর বিরতির পর ৭১ সালে ভোলা সরকারি কলেজ থেকে বিএসসি এবং ৭৩ সালে (পরীক্ষা হয় ৭৫ সালে) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতকোত্তর পাশ করেন।
স্নাতকোত্তর পাশ করেই ৭৫ সালে নিজ গ্রামে বাবা ‘আবুল কালামের’ নামে বড় ভাই ব্যবসায়ী হাসান আলী শরীফের উদ্যোগে ৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজের’ রসায়ন বিভাগের প্রভাষক পদে যোগ দেন তিনি। ২০১৮ সালে কলেজটি সরকারিকরণ হয়। একই স্থানে মা জামেনা খাতুনের নামে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন তার বড় ভাই।
১৯৮২ সালে পিরোজপুরের শহরের হাফিজা বেগমকে বিয়ে করেন ইসাহাক শরীফ। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাশ হাফিজা এখন আবুল কালাম সরকারি কলেজের লাইব্রেরিয়ান পদে কর্মরত। বড় মেয়ে তাসমিন নাহার সুবর্ণা ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করে ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ছোট ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ঢাকার ইউডা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। ৭৫ বছর বয়স্ক ইসাহাক শরীফের মেয়ের ঘরে দুটি নাতি-নাতনী রয়েছে।
তার মেঝভাই আব্দুর রাজ্জাক শরীফ জামেনা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ছোট ভাই সেকান্দার আলী শরীফ ২০১৭ সালে বিএম কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
সরকারি আবুল কালাম কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আফরোজা জাহান বলেন, বিষয়টি একান্তই ইসাহাক শরীফের ব্যক্তিগত বিষয়। আগে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দৈনিক পত্রিকা আসতো না। কাজকে লজ্জা না করে তিনি বৃদ্ধ বয়সে ঘরে বসে না থেকে গ্রামে গ্রামে পত্রিকা বিলি করে ভালো কাজ করছেন। এতে গ্রামাঞ্চলের মানুষ তথ্য-জ্ঞান সমৃদ্ধ হবে এবং নতুন প্রজন্ম তার কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হবে বলে প্রত্যাশা করেন অধ্যক্ষ আফরোজা জাহান।
দেহেরগতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মশিউর রহমান বলেন, ইসাহাক শরীফের সকল কর্মকাণ্ডই ভাল। তার নামে কোনও অভিযোগ নেই। সে শতভাগ ভাল মানুষ। তার কাজকে তিনিও (চেয়ারম্যান) শ্রদ্ধা করেন। সে অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। কিন্তু তার মতো মানুষকে সন্মান জানানোর লোকের বড়ই অভাব সমাজে। সমাজের বেকারদের কাছে ইসাহাক শরীফ অনুকরণীয় হোক সেটাই প্রত্যাশা করেন ইউপি চেয়ারম্যান।