আসন্ন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৭০ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। আর সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী ৫২ জন। ৩০টি সাধারণ এবং ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নির্বাচন করছেন তারা। এদের মধ্যে ১১০ জন কাউন্সিলর প্রার্থী ৩২৪টি মামলা মাথায় নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতরে দাখিলকৃত হলফনামা বিশ্লেষণে এমন তথ্য উঠে এসেছে। তবে এসব মামলা চলমান থাকায় প্রার্থী হিসেবে তাদের বৈধতা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
প্রার্থীদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৬০ সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ১০৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৪৯ প্রার্থীর বিরুদ্ধে চলমান ১৮১ মামলা। আর ৩১ প্রার্থীর নামে অতীতে মামলা ছিল ৬৭টি। উভয় সময়ে মামলা হয়েছে ১৭ প্রার্থীর নামে।
বর্তমানে ২১ প্রার্থীর বিরুদ্ধে ৩০২ ধারার ২২টি মামলা চলমান। এ ধারায় অতীতে তিন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ৬টি মামলা ছিল। উভয় সময় এ ধারায় দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর ৪ নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৯টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি ও জামায়াতপন্থী ২৩ প্রার্থী বিস্ফোরক ও নাশকতা মামলার আসামি। প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন- মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী, খুন ও অপহরণ মামলার আসামিও।
নগরীর ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী আলমগীর হোসেন আলো। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত এই প্রার্থী তার হলফনামায় চলমান তিনটি মামলা দেখিয়েছেন। তবে পুলিশ বলছে, তার বিরুদ্ধে নগরীর মতিহার থানাতেই মামলা রয়েছে ১১টি। এই প্রার্থী থানা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। চোরাচালানির তালিকায় নাম রয়েছে তার।
সর্বশেষ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রাইভেটকার বোঝাই ৮০০ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার হন আলো। ওই ওয়ার্ডের যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক আনার হত্যার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। তার নামে পুলিশের ওপর হামলার মামলারও রয়েছে। এসব মামলায় জমিনে রয়েছেন আলো।
৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী জহিরুল ইসলাম তার হলফনামায় দেখিয়েছেন চলমান ছয়টি মামলা। মাদক, ছিনতাই, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা দায়ের করা হয়। গত ২ এপ্রিল নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানা পুলিশের হাতে সহযোগীসহ গ্রেফতার হন জহিরুল ইসলাম। ওই সময় ১২ হাজার পিস ইয়াবা ছাড়াও চার রাউন্ড গুলিভর্তি একটি পিস্তল উদ্ধার হয় তার কাছ থেকে।
গভীর রাতে নগরীর হড়গ্রাম এলাকা থেকে এক যুবককে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাবার সময় তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই মামলায় এখন কাশিমপুর কারাগারে জহিরুল। রাজশাহী কারাগারে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাকে সেখানে পাঠানো হয়। জহিরুলের হয়ে প্রচারণায় রয়েছে স্বজনরা। পুলিশ বলছে, এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী তিনি।
এদিকে ছয়টি বিস্ফোরক ও নাশকতার মামলা নিয়ে ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিল ও এবারের প্রার্থী হয়েছেন মনসুর রহমান। দুটি করে মামলা রয়েছে ওই ওয়ার্ডের প্রার্থী ইলিয়াস উদ্দিন এবং শহীদ আলমের বিরুদ্ধে। রজব আলী বিরুদ্ধে রয়েছে একটি মামলা।
২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মুখলেসুর রহমানের নামে বিস্ফোরকসহ নাশকতার মামলা ছয়টি। এছাড়া বর্তমান কাউন্সিলর ও এবারের প্রার্থী মো. মাহাবুব সাঈদ টুকুর নামে দুটি এবং নোমানুল ইসলামের নামে একটি করে মামলা রয়েছে।
৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বর্তমান কাউন্সিলর রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও নাশকতাসহ মামলা রয়েছে ৭টি। এছাড়া একটি করে মামলা রয়েছে হাবিবুর রহমান ও আলমগীর হোসেনের নামে।
বিস্ফোরক ও নাশকতার ১৬টি মামলা মাথায় নিয়ে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন কামরুজ্জামান। এই ওয়ার্ডের আরেক প্রার্থী তরিকুল ইসলাম স্বপনের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ত্রাণের টিন আত্মসাতের মামলা হয়। একটি মামলা রয়েছে রেজাউল করিম রিপনের নামেও।
নির্বাচনে রয়েছেন বিতর্কিতরাও। ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী নিযাম-উল আযিম গত পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, প্যানেল মেয়রদের পাশ কাটিয়ে মেয়রের চেয়ার দখল করেন তিনি। তিনিই অযৌক্তিক হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধিসহ জনবিরোধী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেন।
২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরী শ্রমিক নেতা। চালক থেকে কোটিপতি হয়েছেন তিনি। এ দুজনই আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে কাউন্সিলর হয়েছিলেন। তবে বিতর্কিত হওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে নগর আওয়ামী লীগ। ভোটের মাঠে রয়েছেন বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা তৌহিদুল হক সুমন। সম্প্রতি কিশোরের সঙ্গে বিকৃত যৌনাচারে জড়িয়ে দল থেকে বহিষ্কার হন তিনি।
মামলা থেকে বাদ যাননি নারী প্রার্থীরাও। রাসিক নির্বাচনে সাধারণ কাউন্সিলর পদে একমাত্র নারী প্রার্থী হয়ে লড়ছেন ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে নুরুন্নাহার বেগম। তার নামে রয়েছে তিনটি মামলা। গত নির্বাচনে সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। নগর বিএনিপর এই নেত্রী রাসিকের প্যানেল মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন।
দুটি মামলা রয়েছে সংরক্ষিত ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বর্তমান কাউন্সিলর সামসুন্নাহারের নামে। এর মধ্যে একটি মামলায় খালাস পেয়েছেন তিনি। নগরী বোয়ালিয়া মডেল থানার অন্য মামলাটি তদন্তাধীন। সংরক্ষিত ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও এবারের প্রার্থী মুসলিমা বেগম বেলীর বিরুদ্ধে একটি মামলা আদালতে বিচারাধীন। এছাড়া সংরক্ষিত ৭ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী নুরজাহান পারভীনের নামে দুটি মামলার একটি এখনো তদন্তাধীন। অন্যটিতে খালাস পেয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা ও নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান বলেন, মামলা থাকলেও আইনে প্রার্থিতার সুযোগ রয়েছে। তবে কোনো মামলায় দুই বছরের বেশি কারাদণ্ড হয়ে থাকলে তার প্রার্থিতার সুযোগ নেই। সেটি বিবেচনায় প্রার্থী হবার সুযোগ পেয়েছেন তারা।
চানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা ভালো প্রার্থী চাই, ভালো নির্বাচন চাই। কোনো সন্ত্রাসী বা মাদক ব্যবসায়ী কাউন্সিলর নির্বাচিত হলে তার এলাকায় এসব কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাবে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। আমি আশা করি, ভোটাররা কোনো সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ কিংবা মাদক ব্যবসায়ীকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন না।