রক্তাক্ত ২১ আগস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী শান্তি সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা সেদিন অল্পের জন্য এ ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন।
বর্তমানে এ মামলায় আসামি পক্ষের ১৩ জনের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আসামি পক্ষের আরও ৮ থেকে ১০ জনের সাফাই সাক্ষ্য নেওয়া হবে। পরে এ মামলায় উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা করা হবে। এর আগে দু’জন তদন্ত কর্মকর্তাসহ (আইও) ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও তাদের আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জেরা সম্পন করেন। এ মামলায় ৪৯১ জনের মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুইটি মামলার পৃথক চার্জশিটে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৯ জন এখনো পলাতক রয়েছে। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার আইনী এবং কুটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
কয়েক বছর আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান জবানবন্দি দিয়েছিলেন। জবানবন্দির ভিডিওটি ওই সময় বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। যদিও মুফতি হান্নান রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার প্রধান আসামি কিন্তু জবানবন্দির ভিডিওটিতে তিনি গ্রেনেড হামলার জন্য দায়ী করেন বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, আব্দুস সালাম পিন্টু, তারেক রহমান ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবরকে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে গ্রেনেড হামলা মামলার শুনানিতে এ ভিডিও স্বীকারোক্তি জোর করে নেওয়ার অভিযোগও করেছিলেন তিনি।
জবানবন্দির ভিডিওটিতে মুফতি হান্নান জানিয়েছিলেন— হামলার বছর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার মাঝামাঝি পর্যায়ে এর সঙ্গে জড়িত হন মুফতি আব্দুল হান্নান। ১৮ আগস্ট হরকাতুল জিহাদের আমির আব্দুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানউল্লাহ কাজল তাকে খবর দিলে তিনি তাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে একটি কওমি মাদ্রাসায় যান। সেখানে ছিলেন হরকাতুল জিহাদের প্রধান কমান্ডার জাহাঙ্গীর বদর জান্দালও।
তিনি জানান, হরকাতুল জিহাদের নেতারা তাকে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রথম বৈঠক হয় হাওয়া ভবনে। সেই বৈঠকে ছিলেন তারেক রহমান, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, আল মারকাজুল ইসলামের নায়েবে আমির আব্দুর রশিদও।
ওই বৈঠকে তারেক রহমান বলেন, দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা অরাজকতা তৈরি করছে, ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ন করছে। জঙ্গিবাদের কথা বলে দেশকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তখন আলী আহসান মুজাহিদ বলেন, আওয়ামী লীগ ইসলামের বিরুদ্ধেও কাজ করছে। এদের থামাতে কিছু একটা করা দরকার।
লুৎফজ্জামান বাবর বলেন, এ ক্ষেত্রে দুইটা কাজ করতে হবে। প্রথমত, অরাজকতা তৈরির জন্য আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা, নইলে এ দেশ থেকে শেখ হাসিনাকে চিরবিদায় অর্থাৎ শেষ করে দেওয়া দরকার।
এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর চৌধুরী রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার পাশাপাশি শেখ হাসিনার বাড়িতে অথবা আসা যাওয়ার পথে কিংবা কোনো জনসভায় আক্রমণ করে মেরে ফেলার পরামর্শ দেন। শেখ হাসিনার ওপর এই আক্রমণে যেন জনগণের ক্ষতি কম হয় সে দিকে নজর রাখার সুপারিশও করেন নূর চৌধুরী।
বাবর বলেন, তার কাছে গ্রেনেড আছে। সেটা ব্যবহার করা যায় কি না। জবাবে নূর চৌধুরী বলেন, এটা করা যাবে কিন্তু সে ক্ষেত্রে রাস্তায় নয়, আক্রমণ করতে হবে জনসভায়।
পরদিন আরেকটি বৈঠক হয় বলেও জানান হান্নান। তবে পরের বৈঠকটি কোথায় হয় তা বলেননি তিনি। হান্নান বলেন, ওই বৈঠকে বলা হয়, গ্রেনেডের পাশাপাশি রাইফেলও দরকার হবে। সেদিনই ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে হামলার সিদ্ধান্ত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ও গোয়েন্দারা সহযোগিতা করবে বলেও আশ্বাস দেন লুৎফজ্জামান বাবর।
হুজির নেতা আরও জানান, ওই হামলার আগে তৃতীয় বৈঠকটি হয় মিন্টো রোডে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবরের সরকারি বাসভবনে। ওই বৈঠকে তারেক রহমান উপস্থিত ছিলেন না। সেদিন বাবর ছাড়াও ছিলেন জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদের আমির আব্দুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ, সিদ্ধেশ্বরী মাদ্রাসার আরিফুল ইসলাম আরিফ ও মারকাজুল ইসলামের নায়েবে আমির আব্দুর রশিদ। সর্বশেষ বৈঠকটি হয় হামলার তিন দিন আগে। ১৮ আগস্টের ওই বৈঠকটি হয় বিএনপি আমলের শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসায়। সেখানে পিন্টুর ছোট ভাই তাজউদ্দীন ও তার আত্মীয় আবু তাহের ছাড়াও ছিলেন, হরকাতুল জিহাদের আমির আব্দুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ, প্রধান কমান্ডার জাহাঙ্গীর বদর জান্দাল ও সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান উল্লাহ কাজল।
বৈঠক চলাকালে তিনটি কালো গাড়ি যায় ওই বাসায়। এর একটিতে ছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। অন্য দুটি গাড়ি থেকে নামেন আরও দুই জন। বৈঠক চলাকালে একটি সবুজ রঙের ব্যাগ থেকে দুইটি প্যাকেট বের করেন বাবর। এর প্রতিটিতে পাঁচটি করে দশটি এবং আরও দুইটি খোলাসহ মোট ১২টি গ্রেনেড ছিল।
অন্যদিকে, অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় এবং অপর এক মামলায় হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এছাড়া ৮ জন জামিনে রয়েছে। অপর ১৯ জন আসামি বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৮ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান। গত ৮ বছরে যুক্তরাজ্য থেকে কখনো ঢাকায় ফেরেননি তিনি। তাকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনকে (ইন্টারপোল) চিঠি দেবে পুলিশ।
অন্য পলাতক আসামিরা হলেন- শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ সৌদি আরবে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ কলকাতায়, ব্রিগেডিয়রি জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোর্সালীন এবং তার ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন ভারতের কারাগারে এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে।
জঙ্গি নেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) এবং উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান এবং খান সাঈদ হাসান বিদেশে অবস্থান করছে বলে ধারণা করে সূত্র জানায়, তাদের বেশির ভাগই পাকিস্তানে রয়েছে। তবে অপর অভিযুক্ত পলাতক হারিস চৌধুরীর অবস্থান জানা যায়নি। পলাতকদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন ও বাবু এরা দু’জন বিএনপি সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। পিন্টুও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত।
অভিযুক্ত ৫২ জনের মধ্যে বিএনপি’র সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু বর্তমানে জেলে রয়েছে। এই মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবক্স চৌধুরী এবং সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা- সিআইডি’র সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডি’র সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদ জামিনে রয়েছেন।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সূত্র জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অ্যাক্সট্র্যাডিসন ট্রিটি বা বন্দী বিনিময় চুক্তি রয়েছে। এর ফলে দুদেশের মধ্যে আসামিদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের এ ধরণের কোন চুক্তি নেই। তাই ইন্টারপোল ছাড়া তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে ২০১৫ সালে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল ইন্টারপোল। তবে এর কয়েকমাস পরেই কৌশলে ইন্টারপোল থেকে তারেক রহমানের নাম প্রত্যাহার করা হয়। তবে এই রেড অ্যালার্ট নোটিশ কী কারণে প্রত্যাহার করা হয়েছিল বিষয়টি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স জানতো না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিময় সমাবেশ চলাকালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ হামলায় দায়ের মামলার পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার আইনী এবং কুটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে তৎ্কালীন বিরোধী দলের নেতা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির নেতাদের হত্যার উদ্দেশে এ জঘন্য হামলা চালানো হয়েছিল।
এই মামলায় সে সময়ের মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত এবং অপর ৫০০ জন আহত হন। শেখ হাসিনা ওই হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও তার শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২১ আগস্টের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি মামলায় ২০০৮ সালের ১১ জুলাই প্রথম চার্জশিট দাখিল করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং ২১ জন হুজি নেতাকর্মীসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়। নতুন করে তদন্তের পরে ২০১২ সালের ৩ জুলাই অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে পৃথক দু’টি সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করে। দু’টি মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২।