২০ বছর কারাগারে কাটার পর রায় এলো তিনি নির্দোষ

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

স্ত্রী ও নিজ কন্যা সন্তানকে হত্যার দায়ে করা মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে টানা ২০ বছর কারাগারের কনডেম সেলে কাটানো বাগেরহাটের শেখ জাহিদকে নির্দোষ বলে খালাস দিয়ে মুক্তির আদেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে দু’একদিনের মধ্যেই আদেশের অনুলিপি কারাগারে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের বলেছেন আদালত।

আসামির আইনজীবী সারোয়ার আহমেদ বলেন, জাহিদের বিরুদ্ধে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় আপিল বিভাগ তাকে খালাস দিয়েছেন।

তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে জাহিদ কমডেম সেলে আছেন। আপিল মঞ্জুর হওয়ায় এখন তার কারামুক্তিতে বাধা নেই। আপিল বিভাগ রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে আসামিকে দ্রুত মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

তবে, ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পেয়ে তা পর্যালোচনা করে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে শেখ জাহিদের করা জেল আপিল শুনানি নিয়ে তা মঞ্জুর করে ২৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায় দেন।

আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুর্টি অ্যার্টনি জেনারেল বিশ্বজিত দেবনাথ। অন্যদিকে রাষ্ট্রনিযুক্ত (স্টেট ডিফেন্স) আইনজীবী সারওয়ার আহমেদ। আইনজীবীরা জানান, ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি দিবাগত রাতে বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার উত্তরপাড়া এলাকার ভাড়া বাসায় রহিমা ও তার দেড় বছরের কন্যাশিশু রেশমা খুন হয়।

পরদিন রাতে রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিন ফকিরহাট থানায় নিহতের স্বামী শেখ জাহিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন হয় সাতবার। তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর জাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় তদন্ত কর্মকর্তা, যিনি ছিলেন অষ্টম।

মামলার এফআইআর অনুযায়ী জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে বাগেরহাটের ফকির হাট থানার উত্তর পাড়ার ময়েন উদ্দিনের মেয়ে রহিমার সঙ্গে খুলনার রূপসা থানার নারিকেলি চাঁদপুরের ইলিয়াছ শেখের ছেলে জাহিদ শেখের বিবাহ হয়।

জাহিদ শেখ ঘরজামাই থাকতেন। পরে জাহিদ-রহিমার সংসারে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাম রেশমা খাতুন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের তিন মাস আগে রহিমা-জাহিদ বাবার বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি পাকা ঘরে বসবাস শুরু করেন।

১৬ জানুয়ারি বিকাল সাড়ে চারটার দিকে রহিমার মা আনজিরা বেগম মেয়ের বাড়িতে গিয়ে দরজা ভাঙা অবস্থায় দেখতে পান। বাহির থেকে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর কাঁথা ও লেপের নিচে বাচ্চাসহ রহিমাকে শোয়া অবস্থায় দেখতে পান।

কাঁথা সরানোর পর রহিমা ও তার মেয়েকে মৃত অববস্থায় দেখেন। মা-মেয়ের গলায় মাফলার দিয়ে গিট দেওয়া ছিল বলে এফআইরআর-এ উল্লেখ করেন রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিন। মা-মেয়েকে মৃত দেখে আনজিরা বেগম কান্নাকাটি, চিৎকার শুরু করলে পাড়া-প্রতিবেশিরা ছুটে আসেন। ওইদিন সকাল ৯টার দিকে অনেকেই জাহিদকে টেম্পু করে খুলনার দিকে যেতে দেখেছে বলে এফআইআর-এ উল্লেখ করা হয়। তবে, ময়েন উদ্দিনের অভিযোগ জাহিদ শেখ তার মেয়ে ও নাতনিকে রাতের যে কোনো সময় হত্যা করে পালিয়ে গেছেন।

আইনজীবী সারোয়ার আহমে বলেন, ঘটনার পরের দিন জাহিদ শেখকে আসামি করে মামলা করেন রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিন। আসামির বিরুদ্ধে ময়েন উদ্দিনের অভিযোগ জাহিদ শেখ তার স্ত্রী ও দেড় বছরের মেয়েকে খুন করেছে। ৩০২ ধারার অভিযোগ। তবে এ মামলার ২১ জন সাক্ষীর মধ্যে প্রত্যক্ষ কোনো সাক্ষ ছিল না।

রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তার আগেই ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি আসামি আত্মসমর্পন করে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের ২০ জুন আবার জামিনে মুক্তি পান। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর পুলিশ কবে আবার তাকে গ্রেফতার করে তা জানেন না বলে জানান আসামি পক্ষের আইনজীবী।

তবে আইনজীবীর তথ্যমতে, এ হত্যাকাণ্ডের তিন বছরের মাথায় ২০০০ সালের ২৫ জুন বাগেরহাটের জেলা দায়রা জজ আদালতের দেওয়া ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর জেল আপিল করেন। সে হিসাবে আসামি জাহিদ শেখ ২০ বছর ধরে কারাগারে আছেন বলে জানান রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী সারওয়ার হোসেন। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) ও জেল আপিলের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৩১ জুলাই ফাঁসি বহাল রেখে রায় দেন হাইকোর্ট।

ওই বছরেই ২৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামি জাহিদ শেখ জেল আপিল করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে। গত সপ্তাহে সে আপিলের শুনানির পর মঙ্গলবার রায় দিলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এমন খালাস পাওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীও।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলছেন, একজনের জীবন থেকে কনডেম সেলে ২০ বছর হারিয়ে যাওয়া কষ্টের। যারা জড়িত তাদের সাজা হওয়া উচিত।