২০১৭ : দর্শকের ভালোলাগা ‘ঢাকা অ্যাটাক’

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

সিনেমা হলের সামনে মানুষের জটলা। সবার চোখেমুখে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার ছাপ। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আলোচনা করছে, আবার কেউ ফিরে যাচ্ছে হতাশ হয়ে। এমন চিত্র চোখে পড়ে গত ৬ অক্টোবর ‘ঢাকা অ্যাটাক’ মুক্তির প্রথম দিন একটি প্রেক্ষাগৃহের সামনে। তবে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দেখার পরের চিত্র এটি নয়। ছবি শুরুর আগের অবস্থা এটি।

ঘড়িতে তখন রাত ৮টা ৩০ মিনিট। কাউন্টারে রাত ৯টার শোয়ের কোনো টিকেট নেই। দর্শকদের চোখে-মুখে সেদিন ছিল ‘ঢাকা অ্যাটাক’ চলচ্চিত্রের টিকেট না পাওয়ার হতাশার ছাপ। ছবি না দেখে অনেকেই ফিরেছে বাড়ি। প্রথম দিন ছবি দেখব বলে আমিও গিয়েছিলাম হলে। শেষ পর্যন্ত ব্লাকে টিকেট কিনে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দেখতে হলো আমাকেও। প্রেক্ষাগৃহে বর্তমান সময়ে দর্শকখরা। ঠিক এই মুহূর্তে ব্লাকে টিকেট কিনে সিনেমা দেখতে হবে এমনটি ভাবা কল্পনাতীত।

একটি ছবি কী পরিমাণ দর্শকপ্রিয়তা পেলে কালোবাজারে টিকেট কিনতে হয়, তা ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর সময় দর্শকরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এতেই বোঝা যায় দীপঙ্কর দীপন ‘ঢাকা অ্যাটাক’ নির্মাণে কতটা সফল। কারণ, চলচ্চিত্র নির্মাণের সাফল্য-ব্যর্থতা সবটুকু দর্শকের ওপর নির্ভর করে। এই মানদণ্ডে বলতে পারি ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সব থেকে এগিয়ে। পাশাপাশি প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দীপঙ্কর দীপনও সফল।

বর্তমানে দেশের মধ্যে বিশেষ করে সিনেমাপাড়ায় আলোচনার শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করছে ‘যৌথ প্রযোজনা’ ইস্যুটি। এই ইস্যুটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চলচ্চিত্র পরিবারের মানুষের মধ্যে অনেক যুক্তি-তর্ক রয়েছে। তাই আলোচনা ওই দিকটা বাদ দিয়ে আগানোই ভালো। তবে আলোচনা করছি যৌথ প্রযোজনার একটি সিনেমা নিয়ে। ২০১৭ সালে ২৬ জুন ঈদুল ফিতরে বাংলাদেশে মুক্তি পায় ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার রোমান্টিক থ্রিলার জয়দেব মুখার্জি পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নবাব’। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশ-ভারতের শিল্পীরা। শাকিব খান, শুভশ্রী গাঙ্গুলী, রজতাভ দত্ত, সব্যসাচী চক্রবর্তী, অমিত হাসান, অপরাজিতা আঢ্য ও খরাজ মুখোপাধ্যায়। ঈদের মধ্যে যে চলচ্চিত্রগুলো প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়, সেগুলো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের মধ্যে নাম লেখায়। ‘নবাব’-এর বেলায় তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশে প্রথম দিনে ১২৮টি প্রেক্ষাগৃহে ‘নবাব’ দেখে দর্শকরা। বাংলাদেশের পর ভারতে মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রটি। যৌথ প্রযোজনার জন্য দুই দেশের দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্রটি দেখেছে। ব্যবসায়িক দিক থেকেই সফল ‘নবাব’। এর উল্লেখযোগ্য একটি কারণ স্বনামধন্য ও প্রভাবশালী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের জাজ ও ভারতে এসকে মুভিজের ব্যানারে নির্মিত চলচ্চিত্রটি।

‘নবাব’ চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হলেও নানামুখী সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি। চলচ্চিত্রটি ২০১৭ সালের কলকাতার ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ছয় নম্বরে রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক শাকিব খান চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। পর্দায় তাঁর (শাকিব খান) প্রাণবন্ত পারফরমেন্স দর্শকরা এনজয় করেছে বেশ। এ ছাড়া ‘নবাব’-এর চিত্রগ্রহণ, লোকেশন সিলেকশন, ফাইটিং (মারপিট)-এর দৃশ্য, আবহ সংগীত ছিল দুর্দান্ত। চলচ্চিত্র দর্শক ও সমালোচকরা বলেছেন ‘নবাব’-এর চিত্রনাট্যকার, গল্পকার ও পরিচালক দর্শকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ‘বাজি’ (১৯৯৫), ‘সারফারোশ’(১৯৯৯) এবং শাহরুখ খান অভিনীত ‘বাদশাহ’ (১৯৯৯) এই তিন সিনেমার গল্প চুরি করে ‘নবাব’ নির্মিত হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটি কোনো মৌলিক গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে তাঁরা দর্শকদের ঠকিয়েছেন। এই একটি কারণে দর্শকের বিশ্বস্ততা হারিয়েছেন পরিচালক, গল্পকার, চিত্রনাট্যকারসহ চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শিল্পমানের দিক থেকেও ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ‘নবাব’।

যেহেতু ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করছি, তাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর কাছে আবার ফিরে আসছি। দেশের দর্শকরাও এই চলচ্চিত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে বেশ ভালো বলে। এ জন্য এখনো দেশের দু-একটি প্রেক্ষাগৃহে ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর পতাকা উড়ছে। ব্যবসায়িক দিকে থেকে ২০১৭ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এটি। অল্পদিনের মধ্যে কয়েক কোটি টাকা আয় করেছে চলচ্চিত্রটি। সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য, লোকেশন, অভিনয়, শিল্পনির্দেশনা, আবহ সংগীত, পোশাক পরিকল্পনাসহ সবকিছু মিলেই ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দর্শক ও চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের নজর কেড়েছে।

দেশের প্রথম পুলিশ অ্যাকশন থ্রিলার বলা হচ্ছে ‘ঢাকা অ্যাটাক’কে। বাংলাদেশের পুলিশদের কর্মকাণ্ড, তৎপরতা, সাফল্য-ব্যর্থতা, সম্ভাবনা, সততা সবকিছুই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন পরিচালক দীপঙ্কর দীপন। এটি হয়তো কাহিনীকার সানী সানোয়ার-এর জন্য সম্ভব হয়েছে। কারণ, তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পলিশের এডিসি। তিনি তাঁর ভেরতের মূল বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে আনতে পেরেছেন। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সোয়াট ইউনিট, গোয়েন্দা পুলিশ, বোমা নিষ্ক্রিয় ইউনিট, সাংবাদিক সকল কিছুর সমন্বয়ে চলচ্চিত্রের গল্পের সঙ্গে দর্শকরা টানটান উত্তেজনা নিয়ে আগাতে থাকে। বাংলাদেশ পুলিশ সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ টিমকে। পুলিশের বোমা নিষ্ক্রয় স্কোয়াড়ের পোশাক, হেলমেট, গাড়ি, সরঞ্জাম সবকিছু ব্যবহৃত হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। তাই চলচ্চিত্রের পর্দার বাস্তবতায় দর্শকরা বিমোহিত হয়েছে।

‘ঢাকা অ্যাটাক’ চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন দেশের অনেক তারকা অভিনেতারা। তবে চলচ্চিত্র দেখে দর্শকরা বলতে পারবে না কোনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। অভিনেতরা সবাই নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সর্বাত্মক। পর্দায় যে অভিনেতার উপস্থিতি একেবারে কম সময়ে জন্য, সে পর্যন্ত নিজের পারফেক্ট অভিনয় দর্শকদের উৎসর্গ করেছে। অভিনয় করেছেন আরেফিন শুভ, মাহিয়া মাহি, এ বি এম সুমন, শতাব্দী ওয়াদুদ, আলমগীর, সৈয়দ হাসান ইমাম, আফজাল হোসেন, কাজী নওশাবা আহমেদ ও তাসকিন রহমান। শিল্পমান, দর্শক জনপ্রিয়তা, অভিনয়, গতিময়তা, চলচ্চিত্রের ভাষা, বাস্তবতা মিলে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দর্শকের মনে অ্যাটাক করে আজও অবস্থান করছে।
২০১৭ সালে সিনেমা হলগুলোতে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের মধ্যে দর্শকরা বাংলাদেশের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘নবাব’ এ সাড়া বেশি দিয়েছেন। এ দুটি চলচ্চিত্রের নিয়ে সার্বিকভাবে আলোচনা করে সফলতা-ব্যর্থতা নির্ণয় করা খুব মুশকিল। তবে দেশের দর্শকের অভিব্যক্তি ও মন্তব্য নিয়ে এটুকু বলতে পারি ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও ‘নবাব’ মধ্যে গল্পের কাহিনী, চিত্রনাট্য, নির্মাণ, অভিনয়, শিল্পনির্দেশনা, গতিময়তা, চলচ্চিত্রের ভাষা, বাস্তবতা, অ্যাকশন মিলে ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের মধ্যে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনের নবাব ‘ঢাকা অ্যাটাক’।

লেখক : সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী