‘হোমিও চিকিৎসক’ থেকে ‘হেনোলাক্স গ্রুপ’র মালিক

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

হেনোলাক্স কোম্পানিতে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন ব্যবসায়ী গাজী আনিস। লভ্যাংশসহ সেই টাকা তিন কোটির বেশি হয়েছে। তবে কোনো অর্থই পাননি তিনি। এনিয়ে মামলা করেও লাভ হয়নি। এমন অভিযোগ তুলে সোমবার (৪ জুলাই) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেন আনিস। মঙ্গলবার (৫ জুলাই) দগ্ধ আনিস মারা যান। ব্যবসায়ী আনিসের আত্মাহুতির ঘটনায় মামলা হয়। সেই মামলার আসামি কথিত হেনোলাক্স কোম্পানির মালিক নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।

গাজী আনিস ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তার বাড়ি কুষ্টিয়াতে। দগ্ধ হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, আনিসের মুখমণ্ডলসহ শরীরের ৯০ শতাংশ অংশ পুড়ে গেছে। মঙ্গলবার ভোরে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর আনিসের বড়ভাই নজরুল ইসলাম শাহবাগ থানায় মামলা করেন। এতে হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে আসামি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়।

সোয়া কোটি টাকা খুইয়ে আত্মহত্যা করা গাজী আনিস/ফাইল ছবি

এদিকে, গাজী আনিসের আত্মাহুতি, মামলা ও সেই মামলায় গ্রেফতারের পর আলোচনায় এসেছেন কথিত হেনোলাক্স কোম্পানির মালিক নুরুল আমিন।

কে এই নুরুল আমিন?
নুরুল আমিন বর্তমানে আমিন পোলট্রি লিমিটেডের চেয়ারম্যান, আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আমিন ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। এরআগে আমিন হারবাল কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠার কথাও তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে উল্লেখ করেছেন। ফেসবুকে নিজেকে ডা. এন আমিন হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, ব্যবসায়িক জীবন শুরুর আগে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন নুরুল আমিন। ১৯৮৪ সালে হেনোলাক্স কোম্পানি শুরু করার পর তিনি আগের পেশা থেকে সরে এলেও নামের আগে ‘ডাক্তার’ ব্যবহার করছেন। ফেসবুকে তিনি বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছেন, বাস্তবে সেগুলোর কার্যক্রম নেই।

ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় কথিত হেনোলাক্স গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা হিসেবে ৩/১ পুরানা পল্টন, ঢাকা- ১০০০ উল্লেখ করেছেন নুরুল আমিন। নুরুল আমিনের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুরে। ঢাকায় এসে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে হেনোলাক্স প্রতিষ্ঠার পর থেকে তার অবস্থার পরিবর্তন হয়।

যেভাবে নুরুল আমিনের সঙ্গে আনিসের সখ্যতা
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয় দেওয়া নুরুল আমিন কথিত হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের কথা বলে কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী গাজী আনিসের কাছ থেকে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। দীর্ঘদিন চেষ্টা ও মামলা করেও সেই টাকা ফেরত পাননি আনিস। বিষয়টি নিয়ে গত ২৯ মে তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেন। সেখানে তিনি জানান, ২০১৬ সালে নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই সূত্রে ২০১৮ সালে তিনি এ টাকা হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগ করেন।

গত ৩১ মে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সব শেষ স্ট্যাটাস দেন গাজী আনিস। সেখানেও নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের বিচার দাবি করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপও কামনা করেছিলেন তিনি।

ওই স্ট্যাটাসে আনিস লেখেন, ‘২০১৬ সালে হেনোলাক্স গ্রুপের কর্ণধার মো. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে আমার সখ্যতা এবং আন্তরিকতা গড়ে উঠে। আমি কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেছি এবং কুষ্টিয়া শহরেই বসবাস করি। তবে প্রতি মাসেই নিজের প্রয়োজনে ঢাকা এলে তাদের সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হতো এবং উপহার বিনিময় ও ভালো রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতাম। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতেও যেতাম।’

গাজী আনিস লিখেছেন, ‘যেহেতু আমি স্বাচ্ছন্দ্যে দিনযাপনে অভ্যস্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, তাই নিজস্ব গাড়িতেই সবসময় যাতায়াত করি। আমি মো. নুরুল আমিন এবং ফাতেমা আমিনের সঙ্গে নিজের খরচায় দেশের বাইরেও একাধিকবার বেড়াতে গিয়েছি। বিদেশে বসেই ওই দম্পতি তাকে হেনোলাক্সে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন।’

তিনি আরও লেখেন , ‘২০১৮ সালে কলকাতা হোটেল বালাজীতে একইসঙ্গে অবস্থানকালে ওনারা আমাকে হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের এবং যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানান। আমি প্রথমে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরবর্তীতে রাজি হই এবং প্রাথমিকভাবে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। পরবর্তীসময়ে তাদের পীড়াপীড়িতে আরও ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি (অধিকাংশ টাকা ঋণ হিসেবে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে নেওয়া)।’

আনিস আরও লিখেছেন, ‘বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাসের কারণে এবং তাদের অনুরোধে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তি করা হয়নি। তবে প্রাথমিক চুক্তি করা হয়েছে। বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু ওনারা গড়িমসি করতে থাকেন। একপর্যায়ে ওনারা প্রতিমাসে যে লভ্যাংশ প্রদান করতেন, সেটাও বন্ধ করে দেন। কয়েকবার ওনাদের লোকজন দ্বারা আমাকে হেনস্তা ও ব্ল্যাকমেইল করেন এবং করার চেষ্টা করেন। বর্তমানে লভ্যাংশসহ আমার ন্যায্য পাওনা তিন কোটি টাকার অধিক।’

স্ট্যাটাসের শেষ দিকে তিনি লিখেছেন, ‘ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় আমি উল্লেখিত তথ্যাদি উপস্থাপন করলাম। আমার সামনে বিকল্প পথ না থাকায় ফেসবুকেও সবাইকে জানালাম। আমি এই প্রতারক দম্পতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট অনুরোধ করছি। সেইসাথে যারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী তারাও সোচ্চার হবেন বলে আশা করছি।