সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো আইন না মানার প্রবণতা। ক্ষমতার সঙ্গে যুক্তরাই আইন ভাঙ্গছে। ফলে দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এর থেকে উত্তোরণের জন্য নাগরিকদের মধ্যেও আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরী। শুধুমাত্র এনফোর্সমেন্ট এর মাধ্যমে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে দাবী করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তাই শুধুমাত্র সরকার বা কর্তৃপক্ষের উপর দায় চাপানোর পরিবর্তে প্রত্যেক নাগরিককে আইন মেনে সড়ক ব্যবহার করার আহবান জানান সংগঠনটি। এইক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও আইনগত সহযোগিতা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবী জানান তারা।
আজ ০৯ মে বৃহস্পতিবার সকালে নগরীরর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ৫ম বিশ্ব নিরাপদ সড়ক সপ্তাহ উপলক্ষে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত “নিরাপদ সড়ক : আমাদের দায়িত্ব” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
সভায় বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের নানামুখী তৎপরতা দেখা গেলে ও প্রকৃতপক্ষে জাতীয় বাজেটে তার প্রতিফলন হয় না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধ কার্যক্রমের জন্য অর্থনৈতিক কোন কোড নেই। তাই এবারের বাজেটে একটি অর্থনৈতিক কোড চালুসহ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে চালক প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা সৃষ্টি, আক্রান্তদের উদ্ধার, চিকিৎসা সহায়তা ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা তথা ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য জাতীয় বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ প্রদানের জন্য দাবী করেন সংগঠনটি।
মুল প্রবন্ধে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিশ্বব্যাপী সড়ক নিরাপত্তা এখন প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ১.২ মিলিয়ন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আহত হয় ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মানুষ। সংস্থাটির হিসাব মতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে হতাহতের সংখ্যা ( প্রতি ১ লাখ মানুষে যথাক্রমে ২১.৫ ও ১৯.৫ জন ) উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে (১০.৩ জন) তুলনায় অনেক বেশি। লক্ষ্যণীয় ব্যপার হচ্ছে, সারা বিশ্বে নিবন্ধীকৃত যানবাহনের মাত্র ৪৮ শতাংশের শেয়ার নিয়ে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার দায় কাঁধে নিতে হচ্ছে। গত ৪ থেকে ৫ দশক ধরে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিমান হ্রাস পেলেও এসব দেশে এখনও সড়ক দুর্ঘটনাকে মৃত্যু, আঘাত ও পঙ্গুত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারন হিসেবে দেখা হচ্ছে। সংস্থাটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্তের ৪৮ শতাংশ পথচারী, সাইক্লিস্ট ও মোটরসাইক্লিস্ট। যাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এদের মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২১,৩১৬ জন মানুষ। ২০১৬ সালে নিহত হয়েছে ২৪,৯৫৪ জন। অর্থাৎ ৪ বছরের ব্যবধানে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৩,৬৩৮ জন। ২০১২ সালের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রান্তের ৮৫ শতাংশ পুরুষ ও ১৫ শতাংশ নারী । সড়ক ব্যবহারের ধরণ অনুযায়ী এদের ৪১ শতাংশ পথচারী , ১৯ শতাংশ কার ও হালকা যানবাহনের যাত্রী, ১৬ শতাংশ ২ ও ৩ চাকার যানবাহনের যাত্রী, ৯ শতাংশ বাস যাত্রী, ৭ শতাংশ মোটরসাইকেল আরোহী। সংস্থাটি বলছে, ৪১ শতাংশ পথচারী এবং দুর্ঘটনার শিকার অন্যান্য শ্রেণীর ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ হচ্ছে, সমাজের নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষ। ফলশ্রুতিতে, দুর্ঘটনার পর কেউ আহত বা পঙ্গু হলে পরিবারকে চিকিৎসার জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটা বড় ধরনের ব্যয়ভার বহন করতে হয়। আর নয়তো মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুরো পরিবারটি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতির শিকার পরিবারগুলো দরিদ্র থেকে দারিদ্রতায় বা অতি দরিদ্রে পরিণত হচ্ছে।
মুল প্রবন্ধে আরো বলা হয়, সড়কে দুর্ঘটনার ক্ষতির পরিমান বা ভয়াবহতা নির্ভর করে গাড়ির গতিসীমার ওপর। আমাদের দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলো আন্তর্জাতিক মানের নয়। এসব সড়কে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানোর সুযোগ-সুবিধা থাকলে ও চালানো হচ্ছে ১০০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিবেগে। ফলে প্রাণহানি ও সম্পদহানি বেশি হচ্ছে। বেশি গতির কারনে সংঘর্ষে গাড়ির সিলিন্ডার পর্যন্ত বিস্ফোরিত হচ্ছে। তাতে প্রানহানির ভয়াবহতা বাড়ছেই। জাতিসংঘ নির্দেশিত লক্ষ্য অনুসারে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সড়ক নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সকল জাতীয় মহাসড়কে আলাদা সার্ভিস রোড তৈরির দাবীও জানানো হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আশুকরণীয় হিসেবে চালক প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা সৃষ্টি, ডিজিটলি পদ্ধতিতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, বিআরটিএর সক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধি, লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি আধুনিকায়ন, ট্রমা সেন্টার চালু , পরিবহনখাত চাঁদাবাজী ও মাদক মুক্ত করাসহ ১৫ দফা প্রস্তাবনা দেয়া হয়।
সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গোলটেবিলে বক্তব্য রাখেন, বিআরটিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও এফবিসিসিআই’র পরিচালক আবদুল হক, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ, বিআরটিএ’র রোড সেইফটি শাখার সহকারী পরিচালক মোঃ নেয়ামত উল্ল্যা লেনিন, রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সিনিয়র আরবান প্ল্যানার তপন কুমার নাথ, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল, যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরমান হোসেন পলাশ, মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।