উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশকে একটি দক্ষ, চৌকস স্মার্ট পুলিশ বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা সবসময় পুলিশ বাহিনীকে জনগণের পুলিশ হিসেবে গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি পুলিশ সদস্যদের বলতেন, ‘আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। আপনারা বিদেশি শোষকদের পুলিশ নন। জনগণের পুলিশ।’
‘আমি ধন্যবাদ জানাই যে, আমাদের পুলিশ বাহিনী এখন জনগণের পুলিশ হিসেবেই তারা জনগণের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আগে যেমন পুলিশের নাম শুনলে মানুষ ভয় পেতো, এখন জানে পুলিশ সেবা দেয়, তাদের পাশে দাঁড়ায়। মানুষের আস্থা অর্জন করা, জনগণের আস্থা অর্জন করা এটা যে কোনো বাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনারা তা করে যাচ্ছেন।’
জনগণের মনে পুলিশের প্রতি যে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা অক্ষুণ্ন রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বলেন, ‘মানবিক দিক দিয়েই আপনারা সেবা করে যাবেন। আমরা চাই আমাদের পুলিশ বাহিনী জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী হিসেবেই জাতির পিতার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এই কোভিড, যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা না হলে বাংলাদেশ এতদিনে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। ২০৪১ সালে মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ হবে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে স্মার্ট বাংলাদেশ সেটাই আমাদের লক্ষ্য। সেই সাথে সাথে আমাদের পুলিশ বাহিনীকেও আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্মার্ট পুলিশ বাহিনী হিসেবে যাতে গড়ে ওঠে সেই ব্যবস্থা নেবো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক চক্রান্ত আছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। যখনই বাংলাদেশ একটু ভালোর দিকে যায়, তখনই নানা ধরনের চক্রান্ত শুরু হয়। আর সেটা আপনারা জানেন, আমার বাবা, মা, ভাই, ছোট্ট রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে। আমরা যে ক্ষমতায় আসবো এটা কেউ ভাবতে পারেনি। আল্লাহর রহমতে আমরা চতুর্থবারের মতো সরকারে আছি। আর আছি বলেই আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। পুলিশ বাহিনীসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, এই বাংলাদেশ স্বাধীন বাংলাদেশ। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করেও আমরা যে এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাই আহ্বান করেছি, কোথাও এক ইঞ্চি জমি যাতে অনাবাদী না থাকে। প্রত্যেকেই কিছু উৎপাদন করবেন। কারণ বিশ্বব্যাপী খাদ্য মন্দা, অর্থনৈতিক মন্দা। এই ধাক্কা যেন বাংলাদেশে না আসে। সেজন্য আমাদের নিজেদের জন্যই নিজেদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
‘আসুন আমরা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের পুলিশকে একটি দক্ষ, চৌকস স্মার্ট পুলিশ বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাই। কোনো প্রতিবন্ধকতা আমাদের এই অগ্রযাত্রা বাধা দিতে না পারে।’
‘পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩’ উপলক্ষে বাংলাদেশ পুলিশের সব সদস্যকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক ও পুলিশ পদক’ এ ভূষিতদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোন, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে নিহতদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
জাতির পিতা একটি জনবান্ধব, আধুনিক, পেশাদার ও চৌকস পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, তিনি স্বাধীনতার পরপরই পুলিশের বেতন ২৫ টাকা করে বৃদ্ধি করেন। পরিপূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত ৮২টি থানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম নারী পুলিশ নিয়োগ দেন।
’৯৬ সালে সরকার গঠন করে পুলিশের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, পুলিশের বাজেট বৃদ্ধি করি। ঝুঁকি ভাতা চালু করি। রেশন প্রাপ্তির হার দ্বিগুণ করা হয় এবং প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থা করি। আমরা ৫ কোটি টাকা সিড মানি প্রদান করে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করি। ২৫টি থানা, ৮৬টি তদন্ত কেন্দ্র, ৫৮টি হাইওয়ে ফাঁড়ি, ১৫০টি পুলিশ ক্যাম্প এবং ১০টি ফাঁড়ি স্থাপন করি। ৮০৩ জন এসআই, ৫০৭ জন সার্জেন্ট এবং ১৪ হাজার ৬৮০ জন কনস্টেবল নিয়োগ করি। ২০০০ সালে ‘পুলিশ স্টাফ কলেজ’ করি। কমিউনিটি পুলিশ গঠনের উদ্যোগ করি।
ধারাবাহিকভাবে ৩ মেয়াদে সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীর রাষ্ট্রে পরিণত করতে আওয়ামী লীগ সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশকে আধুনিক ও জনবান্ধব করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। পুলিশের আধুনিকায়নে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি।
বিগত ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রাদয়িক গোষ্ঠী সারাদেশে হরতাল-অবরোধ, জ্বালা-পোড়াও ও আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিরীহ মানুষ হত্যা ও সম্পদ ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের প্রেট্রোল বোমা হামলায় ৫০০ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয় এবং ৩ হাজার ১৮০ জন দগ্ধ হয়। এদের হামলায় সাড়ে তিন হাজার বাস-ট্রাক, ১৯টি ট্রেন, ৯টা লঞ্চ পুড়ে ধ্বংস হয়। ৭০টি সরকারি অফিস ও স্থাপনা ভাঙচুর করে এবং ৬টি ভূমি অফিস সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়। পুলিশের সদস্যরা জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করে তাদের ধ্বংসাত্মক রুখে দিয়েছিল এবং জনজীবনে স্বস্তি ও আস্থা ফিরিয়ে এনেছিল।
বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে জঙ্গি-সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক ভিত্তি ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এর ফলে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে।
বিশ্বায়নের ফলে পুলিশের কাজের ক্ষেত্র প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশের কর্মপরিধিতে যুক্ত হচ্ছে সাইবার ক্রাইম, মানিলন্ডারিং, মানবপাচার, জলজ ও বনজ সম্পদ রক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণসহ নিত্য নতুন বিষয়। একইসঙ্গে নিরাপত্তা ও অপরাধের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।