স্বাস্থ্যখাতের সাফল্য আজ এশিয়ার বিস্ময়

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্যসেবাখাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসা চাহিদা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকসমূহের ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়েছে বহুদূর।

শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চলমান কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বিশ্বের অনেক দেশের কাছে মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

 স্বাধীনতার পর ১৯৮৬ সালের জরিপ অনুযায়ী- প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৬৪৮ জন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হতো। ২০১৫ সালে মাতৃ মৃত্যু কমে ১৮১ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ সালের মধ্যে মাতৃ মৃত্যু প্রতি লাখে কমিয়ে ১২১ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) তা কমিয়ে ৭০ জনে আনার লক্ষ্য কার্যক্রম চলছে 

বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যুরোধে এখনো পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক দেশ এখনো পর্যন্ত করোনার সংক্রমণরোধে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে না পারলেও বাংলাদেশে ইতোমধ্যে অর্ধকোটি মানুষের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে।

২০১০ সালে প্রকাশিত গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট : টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস অন শীর্ষক বইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি।

বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট চিকিৎসা সাময়িকী ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে ছয়টি সিরিজে এ দেশের স্বাস্থ্যখাতের সাফল্যকে এশিয়ার বিস্ময় হিসেবে তুলে ধরে। নানাবিধ প্রতিকূলতা এবং অপ্রতুলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অসাধারণ স্বাস্থ্য সাফল্য এবং এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহ অনুসরণীয় বিবেচ্য বলে উল্লেখ করে সাময়িকীটি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের সাফল্যকে বিশ্ববাসীর কাছে অবিরতভাবে তুলে ধরতে প্রয়াত স্বনামধন্য অধ্যাপক হ্যান্স রজোলিং ২০০৭ সালে ইউটিউবে ‘মিরাকল বাংলাদেশ ’ শীর্ষক ভিডিও প্রকাশ করেন যা আজও বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে প্রদর্শিত।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কর্মসূচি
স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দেশের শূন্য থেকে ১৮ মাস বয়সী সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তানধারণে সক্ষম সব নারীকে টিকাদানের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস করা, সংক্রামক রোগ থেকে ও পঙ্গুত্ব রোধ করা এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য।

 গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার সারাদেশে ১৩ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০১৮ তে দেখা যায়- প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫ কোটি মানুষ ক্লিনিকগুলো থেকে সেবা নিয়েছে এবং তাদের ৮০ শতাংশই সেবায় সন্তুষ্ট 

দেশে যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা—এই ১০ রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে সারাদেশে বিনামূল্যে এ টিকাগুলো দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে টিকাদানের হার মাত্র দুই শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৯৮ শতাংশেরও বেশি।

এ কর্মসূচির ফলেই দেশে মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।

মাতৃ ও শিশু মৃত্যু রোধে সফলতা
স্বাধীনতার পর ১৯৮৬ সালের জরিপ অনুযায়ী- প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৬৪৮ জন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হতো। ২০১৫ সালে মাতৃ মৃত্যু কমে ১৮১ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ সালের মধ্যে মাতৃ মৃত্যু প্রতি লাখে কমিয়ে ১২১ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) তা কমিয়ে ৭০ জনে আনার লক্ষ্য কার্যক্রম চলছে।

অপরদিকে ১৯৯৩ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি এক হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে মৃত্যু হার ছিল ১৩৩ জন। ২০১৪ সালে তা কমে ৪৬ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ সালের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু (প্রতি হাজার জীবিত শিশুর) কমিয়ে ৩৪ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের এসডিজিতে তা কমিয়ে ২৫ জনে আনার লক্ষ্য কার্যক্রম চলছে।

১৯৯৩ সালে প্রতি এক হাজার জীবিত নবজাতক শিশুর মৃত্যু হার ছিল (শূন্য থেকে ২৮ দিন বয়সী) ছিল ৫২ জন। ২০১৪ সালে তা কমে ২৮ জনে দাঁড়ায়। বর্তমানে ২০২২ সালের মধ্যে নবজাতক শিশু মৃত্যু (প্রতি হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে) কমিয়ে ১৮ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এবং ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে ১২ জনে আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে।

শিশু মৃত্যু হার রোধে সফলতার জন্য ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে পুরস্কৃত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা নিজেই গ্রহণ করেন।

কমিউনিটি ক্লিনিক
গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার সারাদেশে ১৩ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০১৮ তে দেখা যায়- প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫ কোটি মানুষ ক্লিনিকগুলো থেকে সেবা নিয়েছে এবং তাদের ৮০ শতাংশই সেবায় সন্তুষ্ট।

শুরুটা যেমন ছিল ও পরবর্তীতে যে উন্নয়ন হলো
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে মূলত প্রাথমিক এবং প্রতিরোধমূলক সেবা দিয়ে চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মাত্র ছয়টি মেডিকেল কলেজ, একটি ডেন্টাল কলেজ ও পিজি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতাল দিয়ে মধ্যম ও তৃতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা শুরু হয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং সবার জন্য স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্য অর্জন হওয়া এবং জনগণের স্বাস্থ্য চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমান্বয়ে দেশে প্রতিষ্ঠিত এবং সম্প্রসারিত হতে থাকে মধ্যম পর্যায়, তৃতীয় পর্যায় ও বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহ। গত চার যুগে বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রায় দুইশ মধ্যম, তৃতীয় এবং বিশেষায়িত পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। হৃদরোগ, কিডনি, যক্ষ্মা, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগের ব্যবস্থাপনায় দেশে এখন অর্ধশতাধিক তৃতীয় পর্যায় ও বিশেষায়িত হাসপাতাল সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।

টানা তিনবারের শেখ হাসিনা সরকার রাজধানী ঢাকা থেকে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রাম পর্যন্ত স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে বিস্তৃত করেছে। এখন দেশের অনেক জেলায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। অনুকূল পরিবেশে বেসরকারি পর্যায়েও গড়ে উঠেছে সাধারণ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে শুরু করে উচ্চমানের মধ্যম, তৃতীয় পর্যায় এবং বিশেষায়িত আধুনিক স্বাস্থ্য স্থাপনা। বিশ্বমানের জটিল অস্ত্রোপচারসহ প্রতিদিন অসংখ্য রোগীর চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে এসব হাসপাতালে।

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই আগে ছিল না
দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই আগে ছিল না। শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে সরকার গঠন করে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আইপিজিএমআরকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার প্রস্তাব দেন। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা যেমন রোগীর চিকিৎসা, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান চিকিত্সকদের উচ্চতর ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ এবং সর্বশেষ জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।

তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে শেখ হাসিনা আরও তিনটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই আইন পাশ হয়েছে। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় দুটির জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন ও নির্মাণ কাজ শিগগিরই শুরু হবে।

ওষুধ শিল্পের বিকাশ
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি ওষুধ আমদানি করতে হতো। মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়রোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের অধীনে প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানির লক্ষ্যে একটি সেল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু দেশে মানসম্মত ওষুধের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এ শিল্পকে সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে ‘ওষুধ প্রশাসন পরিদফতর’ গঠন করেন। দেশে মানসম্পন্ন ওষুধ নিশ্চিত করার জন্য ওষুধ উৎপাদন, বিপণন এবং আমদানি-রফতানি অধিকতর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ওষুধ প্রশাসন পরিদফতরকে অধিদফতরে উন্নীত করেন। দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৪৫টি দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে। গত ছয় বছরে ওষুধ রফতানি বেড়েছে পাঁচ থেকে ৩১ বিলিয়নে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক লেভেল-১ (মডেল ফার্মেসি) এবং লেভেল-২ (মডেল মেডিসিন শপ)-এর বৈশিষ্ট্য অনুমোদন দেয়া হয়। মডেল ফার্মেসিগুলো গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট দিয়ে পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে ২২টি জেলায় ৪২১টি মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ উদ্বোধন করা হয়েছে। ফার্মাকোভিজিল্যান্সের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এডিআরএম সেল ডব্লিউএইচও ওপসালা মনিটরিং সেন্টারের ১২০তম সদস্যপদ পেয়েছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রিপোর্টিং, নকল ওষুধ ও নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্যে বিক্রয়ের বিষয়ে অনলাইনভিত্তিক অভিযোগ দাখিলের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। আমদানিকৃত এবং দেশে উৎপাদিত ওষুধের ব্লক লিস্ট অনলাইনে অনুমোদনের জন্য একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হয়েছে। এদিকে সরকারের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানি এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহে ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধিতে আরও সক্ষমতা অর্জনের জন্য গোপালগঞ্জে একটি বিশাল ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছে।

স্বাস্থ্যখাতে তথ্য প্রযুক্তির নীরব বিপ্লব
দরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থাকে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে যা জাতীয় পর্যায়ের হাসপাতাল থেকে করে কমিউনিটি ক্লিনিক ও গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার দেশের জাতীয়, বিভাগীয় এবং জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পর্যালোচনামূলক ভিডিও কনফারেন্সিং অনুষ্ঠিত হয়। মাসের তৃতীয় সোমবার এ কনফারেন্সে সব উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক নিজ নিজ জেলার সিভিল সার্জন অফিসের ভিডিও কনফারেন্সে উপস্থিত থেকে যুক্ত হন।

প্রায় ১০০টি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করা হয়েছে। ‘হেলথ কল সেন্টার স্বাস্থ্য বাতায়ন’ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ১৬২৬৩ এই নম্বরে ফোন করে দিনরাত যে কেউ বিনামূল্যে চিকিৎসকের পরামর্শ, অ্যাম্বুলেন্স বুকিং, অভিযোগ ও পরামর্শ জানানো এবং স্বাস্থ্য তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ নিতে পারেন।

এছাড়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত অভিযোগ গ্রহণ ও পরামর্শের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা মূল্যায়নভিত্তিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ফিঙ্গার প্রিন্ট রিমোট ইলেক্ট্রনিক অফিস অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশকে ডিএএচআইএস২ সফটওয়্যারের বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ জন্য জার্মান সরকার ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে বেস্ট প্র্যাকটিস অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে এবং এ কোয়াইট রিভুলিউশন ইন হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ নামে একটি বিশেষ বই প্রকাশ করে।

অনলাইনে প্রতিটি কমিউনিটির প্রসূতি মা ও অনূর্ধ্ব পাঁচ শিশুদের নিবন্ধন ও ট্র্যাকিং করার পদ্ধতি চালু হয়েছে। জিও কো-অর্ডিনেটভিত্তিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রি চালু হয়েছে। এমবিবিএস এবং ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রতিটি স্তর ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিচ্ছিদ্র পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া প্রবর্তন করা হয়েছে। সর্বাধুনিক ডাটা সেন্টার এবং রিমোট ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে এসিআর সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্যখাতের অর্জন ও সমস্যা বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, গত ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সূচকসহ (গড় আয়ু বৃদ্ধি, টিকাদানের হার, শিশু ও মাতৃ মৃত্যু রোধ) প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অভাবনীয় সফলতা এসেছে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। একসময় বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা জেলা ও উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘দেশে গত ৫০ বছরে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ও বিশেষায়িত শিক্ষা ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক, শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি হয়েছে; যারা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখছেন। একসময় বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করা হতো। বর্তমানে ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন হয়।

অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান আরও বলেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে জনবান্ধবমুখী করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ জনবল তৈরির ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারের বিষয়টিতে নজর দেয়া প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ের হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগিতার বিষয়টিতে খেয়াল রাখলে রাষ্ট্রীয় খরচ কমবে এবং সাধারণ মানুষ আরও কম খরচে চিকিৎসা পাবেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্যখাতে বিশাল অর্জন রয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে টিকাদান কর্মসূচি, শিশু ও মাতৃ মৃত্যু ও পুষ্টি উন্নয়নে ব্যাপক সফলতা রয়েছে। দেশে গড় আয়ু ৪০ বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ বছর হয়েছে।

তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে বিশাল স্বাস্থ্য অবকাঠামো রয়েছে। সেখানে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। যার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে আনুপাতিক হারে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট না থাকায় সরকারি স্বাস্থ্য স্থাপনায় কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করা যাচ্ছে।

অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, মানুষকে পকেটের টাকা খরচ করে অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে সেবা কিনতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারকে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিয়ে আগামী পাঁচ বছরে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টসহ প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি করা, রোগীদের কম খরচে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।