স্বামীর মরদেহ দেশে আনতে পারেননি, স্ত্রীও আটকা ভেলোরে

:
: ৩ years ago

ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান স্বামী আর জে রাশেদ রাজ (২৭)। কিন্তু করোনা হওয়ায় দেশে লাশ আনতে পারেননি। তাই ভারতের ভেলোরেই দাফন করতে হয়েছে তাকে। স্বামী হারানোর শোকে পাথর স্ত্রী ফারজানা আক্তার একাই দেশে ফেরার অপেক্ষায়। বিদেশ বিভুয়ে থেকে কবে স্বজনদের কাছে ফিরবেন সেই অপেক্ষায় তিনি। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ থাকায় স্বামী হারানোর বেদনা নিয়ে শুধু চোখের জলেই ভাসছেন তিনি।

আর জে রাশেদ রাজ তিন বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। গত বছর লকডাউনের সময়ও তিনি ভেলোরে আটকা পড়েছিলেন। এবার স্ত্রীসহ ১৯ জানুয়ারি আবার ভেলোরে যান। এরপর ৫ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। ২৬ এপ্রিল মারা যান। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় লাশ দেশে আনা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে রাজের স্ত্রী ফারজানা আক্তারের সঙ্গে অনলাইনে একাধিকবার কথা হয়।

জামালপুরের অধিবাসী ফারজানা বলেন, ‘আমার স্বামী তো হারালাম। লাশটাও আমাদের পরিবারের কাছে নিতে পারলাম না। এখন আমি এখানে একা। শুধু বসে বসে স্বামীর জন্য বিলাপ করি। আমার দেখা আরও একজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ওই লাশও দেশে নিয়ে যাওয়া যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘শুনছি অনেকেই বর্ডার পার হয়ে দেশে যাচ্ছে। কিন্তু আমি একজন মেয়ে হয়ে সেভাবে যেতে পারব না। তাই সরকারের কাছে আমার আবেদন আমাদের যেন দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেন।’

শুধু ফারজানার স্বামী কেন, এরকম আরও অনেকের কবর হয়েছে ভারতে। কোনো কোনো রোগী চিকিৎসা শেষ করে দেশে ফেরার অপেক্ষা করছেন। এক আত্মীয়কে কিডনি দিতে গিয়ে কলকাতায়ই আটকে গেছেন রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজন।

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী কলেজের অধ্যাপক এমডি এ আজিজের (৫৭) কিনডি নষ্ট হয়ে যায়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতার আর এন ঠাকুর হাসপাতালে তার অপারেশন হয়। কিন্তু কিডনিদাতা এমডি ভুলু ও তার স্ত্রী এখন দেশে ফেরার সময় হলেও আটকে আছেন সেখানে।

রোগী এমডি এ আজিজের মেয়ে আতিয়া আফরোজ পূর্ণা কলকাতা থেকে বলেন, ‘আমরা কলকাতার মুকুন্দপুরের বন্দনা গেস্ট হাউসে আটকা পড়ে আছি। বাবার কিডনি ডোনার ও তার স্ত্রী দেশে ফিরতে পারবেন বলে ডাক্তার জানিয়েছেন। কিন্তু সবকিছু বন্ধু থাকায় তারা দেশে ফিরতে পারছেন না। এজন্য ভিন দেশে খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’

ভেলোরে চিকিৎসা নিয়ে নদীয়া জেলায় আটকা পড়েছেন বরিশালের শংকর চন্দ্র দেবনাথ । তিনি পায়ুপথের অপারেশন শেষে সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় আছেন।

তার ছেলে সুব্রত দেবনাথ বলেন, ‘আমার বাবার অপারেশনের জায়গায় নিয়মিত ড্রেসিং করতে হয়। চলতে ফিরতে সমস্যা হয়। এভাবে কত দিন আত্মীয়ের বাসায় থাকা যায়? এরপর শুনেছি দেশে ফিরলে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। কিন্তু এরকম একজন রোগীকে নিয়ে কীভাবে কোয়ারেন্টাইনে থাকব?’

 

জিয়াউল আহসান জুয়েল নামে একজন বলেন, ‘আমার ছেলে আরিয়ানের চিকিৎসা করতে এসে ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে আছি। মেডিকেল ভিসায় গত ডিসেম্বরে এসেছি। আমরা চারজন। সাত মাসের একটা বেবি আছে সাথে। আমরা দেশে ফিরতে চাই। আমাদের ভিসার মেয়াদ চলতি মাসের ২৭ তারিখ শেষ হবে। এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’

ভারতে চিকিৎসা নেয়া সংক্রান্ত অনেকগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক গ্রুপ আছে। মূলত এসব গ্রুপে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়। গত বছর করোনার সময় ভারতে আটকে পড়াদের তালিকাও করা হয় এসব গ্রুপের মাধ্যমে। পরে তা দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাঠানো হয়। হাইকমিশন তাদের দেশে ফিরিয়ে আনে।

এরকম একটি গ্রুপের মডারেটর মোস্তাফিজুর রহমান সরকার জানিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন শহরে যারা আটকা পড়েছেন, তাদের তথ্য নেয়া হচ্ছে। গত বছরের মতো বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন তাদের দেশে ফেরার জন্য সহযোগিতা করবে। এখন পর্যন্ত ৩০০ জনের মতো তালিকাভুক্ত হয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ভারতে বিভিন্ন কারণে গিয়ে যারা আটকা পড়েছেন তাদের ব্যাপারে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত জানাবে। দিল্লিতে অবস্থিত হাইকমিশন এ ব্যাপারে কাজ করছে। তালিকার কাজ অনেক এগিয়ে গেছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ১৪ দিনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত বন্ধ রয়েছে। ২৫ এপ্রিল এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে আকাশপথও বন্ধ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসার জন্য যায়। এর বেশির ভাগই যায় ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে (সিএমসি)। ১১৮ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালের চিকিৎসার মান অনেক ভালো। খরচও তুলনামূলক কম। এজন্য বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার রোগী নিরাময়ের আশায় সেখানে যান। রোগীরা সেখানে চিকিৎসা নিয়েও স্বস্তিবোধ করেন। কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা হওয়ায় বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের ভিড় প্রচুর। সেখানে সিএমসি ছাড়াও নারায়ানা হুদ্রালয়া হাসপাতালে যান অনেকে। গত বছরও চিকিৎসার জন্য গিয়ে কয়েক হাজার রোগী ও তাদের স্বজন আটকা পড়েছিলেন। পরে ব্যক্তিগত ব্যবস্থা ছাড়াও সরকারের সহযোগিতায় তারা দেশে ফেরেন।

গত বছরের মে মাসে প্রায় দুই হাজার দুইশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে প্রথমবারের মতো ভারত থেকে সড়কপথে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ৪৭ যাত্রী। দুদিন ভ্রমণ করার পর ভেলোর থেকে বেনাপোল হয়ে দেশে ফেরেন তারা। এর আগে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অনেকে দেশে এলেও বাস চলাচলের নজির ছিল না। এরপর আরও কয়েকটি বাস আসে।