মেসির গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা দলের হয়ে। তবে শুরুটা ধরা যায় ২০০৬ বিশ্বকাপে। ততোদিনে মেসির নাম রটে গেছে। মুখে দাড়ি-গোঁফ গজায়নি এমন এক ছেলে আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন। বিস্ময় বালক বলে ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম। কিন্তু তখনো তিনি নিতান্তই বালাক। বয়স সবে ১৮। মুখের তুলনায় নাকটা একটু বেশিই বড় দেখায়।
২০০৬ বিশ্বকাপে মেসিকে নিয়ে বলতে গিয়ে রিকার্দো সোলারি বলেন, ‘মেসি দেশের হয়ে প্রথম মাঠে নামলেন আর ফুটবলের মঙ্গল হলো।’ কিন্তু সেই ২০০৬ বিশ্বকাপে মেসিকে নিয়ে আক্ষেপ আছে সমর্থকদের। তাকে যে মাঠেই দেখা গেছে সামান্য। কখনো ১০ মিনিট তো কখনো ১৫ থেকে ১৯ মিনিট। এই হলো মেসির ২০০৬ বিশ্বকাপ খেলা। তবে বিশ্বকাপটা তিনি দেখে এসেছিলেন সেবার।
রিকার্দো বলেন, ‘সেবার মেসি দলকে ১৫-২০ মিনিট করে সময় দিতে পেরেছিল। তার মতো কম বয়সী একজন ফুটবলার ৯০ মিনিট খেলতে পারে এটা আমাদের ধাতব্যে ছিল না। তবে সে মাঠে নামলে দারুণ কিছু পার্থক্য চোখে ধরা পড়ে। চার-পাঁচটা সুযোগ তৈরে করেছিল সে। আমি তাকে বলেছিলাম চার-পাঁচজনকে কাটিয়ে চারটা-পাঁচটা সুযোগ তৈরির থেকে একটি গোল করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ মেসি অবশ্য সেবার তিন ম্যাচ মাঠে নেমে একটি গোল করার পাশাপাশি সহায়তা করেছিল এক গোলে।
২০০৬ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে হেরে বিদায় নিয়েছেল আর্জেন্টিনা। কিন্তু ভক্তদের মনে ক্ষোভ ছিল মেসিকে ঠিক মতো ব্যবহার না করার জন্য। সেবার জার্মানির ঘরের মাঠে জার্মানরা আগ্রাসীভাবে খেলেছিল। অনেকে ধরে নেন ‘বালক সুলভ’ মেসিকে বেশি না খেলানো আসলে ঠিক সিদ্ধান্তই ছিল।
এরপর ২০১০ বিশ্বকাপ। দক্ষিণ আফ্রিকা। মেসি দলের প্রাণভ্রমরা হয়ে খেলতে গেছেন। তখন মেসি ফুটবলের অবিসংবাদী নেতা বনে গেছেন। জিতে ফেলেছেন ক্যারিয়ারের প্রথম ব্যালন ডি’অর। আর্জেন্টিনা দলের কোচ বিশ্বকাপ জয়ী দিয়াগো ম্যারাডোনা। আর মেসি সেই দলের প্রাণ। অনেকে বলতে লাগলেন প্রফেসর তার সেরা ছাত্রকে নিয়ে বিশ্বকাপ জিততে এসেছেন। সে সময় ম্যারাডোনার দলের ফিটনেস কোচ ছিলেন ফার্নান্দো সিগনোরিনি।
তিনি বলেন, ‘ম্যারাডোনার সঙ্গে মেসির সম্পর্ক ছিল দারুণ। এটা অনেকটা প্রফেসরের সঙ্গে তার সেরা ছাত্রের মতো। পারস্পারিক একটা শ্রদ্ধা ছিল তাদের মধ্যে।’ তবে সেবার মেসি দলের হয়ে পাঁচ ম্যাচ খেলে কোন গোল করতে পারেনি। এক গোল করতে সহায়তা করেছিলেন মাত্র। কোয়ার্টার ফাইনালে ৪-০ গোলে হেরে বিদায় নেয় মেসিরা। ‘ক্লাব বয়’ তকমাটা মেসির গায়ে ওই বিশ্বকাপেই শেটে যায়।
ফার্নান্দোর মতে, ‘ম্যারাডোনার সেবারের দল ছিল বেশ তরুণ। তার তরুণ আক্রমণ নিয়ে জার্মানির অভিজ্ঞ আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। তখনো মেসির বয়স ২৩। খুব বেশি পরিণত বলা যাবে না। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার বয়স ছিল ২৩ বছর। ম্যারাডোনা ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জিতে সর্বকালের সেরাদের কাতারে উঠে যান।’ সে হিসেবে মেসির জন্য ব্রাজিল বিশ্বকাপ ছিল পরিণতির ছোঁয়া দেখানোর মঞ্চ। মেসি তা দেখায়ও। কিন্তু হারেন ফাইনালে।
ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ২০১৪ বিশ্বকাপে তো মেসিকে সর্বকালের সেরাদের একজন বলে আখ্যা দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। বড় কোন শিরোপা তিনি দলের জার্সিতে জিততে পারেনি। কিন্তু ক্লাবের হয়ে তিনি যে পারফর্ম করেছেন তাতে তার প্রতিভা এবং দক্ষতা স্পষ্ট হয়ে গেছে। দক্ষিণ আমেরিকায় বিশ্বকাপ বলে মেসির সামনে সুযোগটাও ছিল ভালো।
ব্রাজিল বিশ্বকাপে মেসিদের সম্ভাবনা নিয়ে ফার্নান্দো বলেন, ‘আমরা জানতাম মেসি এবং অন্যদের জন্য ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে আলাদা কিছু। কারণ দলের সবার চার বছর অভিজ্ঞতা বেড়ে যাবে। তবে মেসি ওই বিশ্বকাপেও ছিলেন নিরব নেতা। জনসম্মুখে যেতে তিনি পছন্দ করতেন না। তার মধ্য থেকে লজ্জা-লজ্জা ভাবটা তখনো যায়নি। শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে। তবে ওই সেই জার্মানি বাঁধা! নিজের খেলা তিন বিশ্বকাপের তিনটিতেই জার্মানির বিপক্ষে হারেন মেসি। দলগত খেলায় সমর্থকদের মন জয় করতে পারেনি আর্জেন্টিনা। তবে মেসির খেলা সমর্থকদের মন জয় করে।
আরো চারটি বছর পার হয়ে গেছে। মেসি চারটি বিশ্বকাপে অংশ নিতে যাচ্ছেন। মেসির মতো এমন তিনটি-চারটি করে বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন রোনালদো-ক্লোসারা। কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে মেসির প্রাপ্তি সামান্য। ১৮ বছরের সেই বালকের মাথায় লম্বা চুল নেই। মসৃণ মুখে এখন দাড়ি-গোঁফে ভর্তি। সোনালী আভা পেয়েছে সেগুলো। সময় পাল্টেছে, পাল্টেছেন মেসিও। শুধু বিশ্বকাপের ট্রফিটা হাতে নিয়ে পোজ দেওয়া হয়নি এখনো। হয়তো রাশিয়া তাকে সুযোগ দিচ্ছে। শেষবারের মতো।