সিলিন্ডার বিস্ফোরণ : নিয়ন্ত্রণে নেই কেউ

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

# মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ তাজা বোমার মত ভয়ঙ্কর
# সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট সংস্থা 
# মান নিয়ন্ত্রণে তেমন কার্যকর ভূমিকাও নেই

রাজধানীতে গ্যাস সংকট নিত্য সমস্যা হওয়ায় রান্নার ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বাড়ছে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবহার। এ সুযোগে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে মানহীন এলপিজি সিলিন্ডার। তবে মানহীনতার কারণে বাড়ছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। তাই রাজধানীতে নতুন আতঙ্কের নাম সিলিন্ডার বিস্ফোরণ।

তবে এটির মান যাচাই বা নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো সংস্থা। হ-য-ব-র-ল ভাবে চলছে এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদন, সরবরাহ, বিক্রি ও ব্যবস্থাপনা।

এলপিজি সিলিন্ডার শুধু বাসা বাড়ি কিংবা হোটেল-রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজে নয়, বর্তমানে যানবাহনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বর্তমানে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার সংখ্যা প্রায় দেড় কোটিতে পৌঁছেছে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার ও নানা ত্রুটির কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা। তবে মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানো এবং ব্যবহারকারীদের সচেতনতা কমাতে পারে প্রাণহানি ও দুর্ঘটনা।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ে ১৩ নম্বর রোডের একটি টিনশেড ঘরে স্ত্রী সাজেনা আখতারকে (১৮) নিয়ে থাকতেন সাইফুল ইসলাম (২৫)। গত ৬ নভেম্বর ভোর ৫টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় দগ্ধ হন তারা। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেয়া হলে ওই দিনই মারা যান সাইফুল। তবে এখনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন সাজেনা।

এর আগে ১ নভেম্বর রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে পিকআপ ভ্যানের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। ওই ঘটনায় যানবাহন ও আশপাশের থাকা আটজন দগ্ধ হয়ে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। এভাবেই অনেক মানুষ সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহত হলেও এটি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে গ্যাস অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ১৫৬টি। এর মধ্যে রাজধানীতে ৩৭টি আর বাইরে ঘটেছে ১১৯টি। এসবের মধ্যে গ্যাস লাইনে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ৭৬টি আর সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৮০টি। এতে আহত হয় ৩৬ জন।

তবে ২০১৬ সালে গ্যাস দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এ বছর গ্যাস অগ্নিকাণ্ড ৪০টি বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৬ এ। এরমধ্যে রাজধানীতে দুর্ঘটনা ঘটে ৪০টি আর বাইরে ১৫৬টি। এসবের মধ্যে গ্যাস লাইনে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ৬৫টি আর সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১৩১টি। অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছে ৪১ জন। আর মারা গেছে চারজন।

২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গ্যাস লাইনে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ৫৮টি, সিলিন্ডরে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ৭৯টি। এতে আটজন আহত হলেও মারা যান একজন।

এদিকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে চুলা থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার সংখ্যা ২৩৮টি, আর গ্যাস লিকেজের জন্য ঘটেছে ৬৫০টি দুর্ঘটনা।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আলী আহম্মেদ খান বলেন, পাইপ লাইনে গ্যাস সঙ্কটের কারণে সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। চাহিদার বেশির কারণে মানহীন সিলিন্ডারও বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণেই সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনা বাড়ছে। এ ছাড়া সিলিন্ডার ব্যবহারে মানুষের সচেতনতারও ঘাটতি রয়েছে। এটাও দুর্ঘটনা অন্যতম কারণ।

তিনি বলেন, সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট সংস্থা নেই। যেসব সংস্থা মান নিয়ে কাজ করে তাদেরও মান যাচাইয়ে সঠিক সক্ষমতা নেই। বিস্ফোরক পরিদফতর এ বিষয়ে দেখার করা থাকলেও বিভিন্ন কারণে তারা পারছে না। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আলোচনা করেছি। শিগগিরই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের ডিজি।

দুর্ঘটনা রোধে সিভিল ডিফেন্স কী পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাইলে মহাপরিচালক আলী আহম্মেদ খান বলেন, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। এলাকাভিত্তিক এ প্রচারণায় সিলিন্ডার ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের কর্মীদেরও এ বিষয়ে সতর্কতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ তাজা বোমার মত ভয়ঙ্কর। আইন করে সিলিন্ডার রিটেস্ট বাধ্যতামূলক করা হলে অনেকাংশেই এ ঝুঁকি কমবে। সরকারের উচিত খুব শিগগিরই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া।

এ বিষয়ে বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাস রূপান্তরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সিলিন্ডার পরীক্ষা করা হয়। সরকারের রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানিতে (আরপিজিসিএল) সিএনজি কনভারশন ও রিটেস্টিং করে থাকে। সারাদেশে ৫৮৭টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে রিটেস্ট সেন্টার ছিল ১৪টি। তা এখন বেড়ে হয়েছে ১৯টি।

তিনি বলেন, বিস্ফোরণ রোধে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে আইন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে।

এদিকে বিস্ফোরক আইনের শর্ত লঙ্ঘন করে মজুদ করা হচ্ছে সিলিন্ডার। অনুমোদন ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিক্রিও করা হচ্ছে এসব সিলিন্ডার। ফলে প্রায় ঘটছে দুর্ঘটনা। মারাও যাচ্ছে অনেকে। তাই মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে মাঠে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।

অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ পরিচালক (উপ সচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে অধিদফতরের পক্ষ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হচ্ছে। বিস্ফোরক আইনের শর্ত লঙ্ঘন করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে সিলিন্ডার মজুদ করায় এ পর্যন্ত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়েছে। তবে অভিযানে দেখা গেছে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ ছাড়া সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণে তেমন কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে সিলিন্ডার উৎপাদন, সরবরাহকারী ও বিক্রেতাদের সতর্কতার পাশাপাশি মান যাচাই সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

জানা গেছে, সারাদেশে এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহ করার অনুমোদন রয়েছে ৬০টি কোম্পানির। এরমধ্যে ১৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহ করছে না। বসুন্ধরা, ওমেরাসহ কয়েকটি কোম্পানি নিজেরাই সিলিন্ডার তৈরি করে। শুধু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি হয়েছে ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭২৮টি। আর দেশে তৈরি হয়েছে ১১ লাখ চার হাজার ৩৩৫ সিলিন্ডার। গত পাঁচ বছরে বোতলজাতকরণ হয়েছে এক কোটি ২৩ লাখ সিলিন্ডার। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসব সিলিন্ডার অনুমোদন ও ব্যবহার বিধি প্রচার করে বিস্ফোরক পরিদফতর।