সিটিবাসের ই-টিকিটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংযোজন চাই যাত্রী কল্যাণ সমিতি

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

ঢাকা, ২৪ নভেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার : আধুনিক গণপরিবহন সেবায় ই-টিকেটিং ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতারা দাবী করেন, পরিবহন খাতে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি এই খাতের আমুল সংস্কার করা না গেলে ই-টিকেটিং সিস্টেমে সিটিবাস সার্ভিস ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কেননা ই-টিকিটে দুরুত্ব অনুযায়ী ভাড়া আদায় নিশ্চিত করায় যাত্রী ভাড়া কমে আসছে, ফলে বাস মালিকের আয়ও কমে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বাসে বাসে কোম্পানীর জিপি ও অদৃশ্য খাতের রুট খরচ বন্ধ করা না গেলে অনেক পরিবহন মালিককে লোকসান দিয়ে বাস চালাতে হবে। যানজট, চাদাঁবাজীসহ নানা কারনে দীর্ঘদিন যাবৎ সিটি সার্ভিসের বাস খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। ফলে লোকসানের কারনে এই খাত আগামী দিনে গভীর সংকটে পড়ার শংকা রয়েছে।

আজ ২৪ নভেম্বর সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুনি হলে “ঢাকা সিটিবাস সার্ভিসে ই-টিকিটিং : যাত্রীদের প্রত্যাশা” শীর্ষক বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা উপরোক্ত মন্তব্য করেন। সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। আলোচনা সভায় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি কর্তৃক বাসে বাসে প্রদানকৃত ই-টিকিটের ছবি ও যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রস্তাবিত ই-টিকিটের নমুনা প্রদর্শন করা হয়।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, টিকিট মানে সেবা মূল্যের রশিদ। আন্তর্জাতিক ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী প্রতিটি পণ্য বা সেবামূল্যের রশিদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দীর্ঘদিন পর নগরীর সিটি সার্ভিসের বাসে ই-টিকেটিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে এটি পূরনে এগিয়ে আসায় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দকে তিনি ধন্যবাদ জানান। প্রতিটি টিকিটে টিকিট প্রদানকারী বাসের নাম, বাসের নিবন্ধন নাম্বার, যাত্রা ও গন্তব্যের নাম, দুরুত্ব, ভাড়ার অংক, ভ্রমণ তারিখ ও অভিযোগ কেন্দ্রের নাম্বার সমূহ থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে প্রদত্ত ই-টিকেটিং ব্যবস্থায় এসব পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। কোন কোন টিকিটে শুধুমাত্র ভাড়ার অংক লেখা রয়েছে। যাত্রা ও গন্তব্যের নাম, বাসের নাম ও নাম্বার নেই, ফলে এসব টিকিট দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলে যাত্রীদের প্রতিকার পাওয়ার কোন সুযোগ নেই বলে তিনি দাবী করেন।

সংগঠনের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, শুরুতেই ই-টিকেটিং নিয়ে যাত্রী, বাস মালিক-শ্রমিকের মধ্যে নানা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ই-টিকেটিং চালুর পর বিভিন্ন রুটে মালিকেরা বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেয়। ই-টিকেটিং এ চলাচলকারী বাসে দুরত্বের ব্যবধানে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেন নগরীর যাত্রী সাধারণ। যেমন রামপুরা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার আগে এই পথে ভাড়া ছিল ২০ টাকা, ই-টিকেটিং এ এই পথের ভাড়া আদায় হচ্ছে ২৫ টাকা। অথচ ৮ কিলোমিটার এই পথে ২০ টাকা ভাড়া আদায় হওয়ার কথা। খিলক্ষেত থেকে মিরপুর-২ আগে ১৫ টাকা ভাড়া আদায় হলেও ই-টিকেটিং চালুর পর ২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কোন কোন পথে ভাড়া কমে আসার নজিরও রয়েছে, যেমন খিলক্ষেত থেকে মিরপুর-১১ পথে নিয়মিত যাত্রী রাকিবুল হাসান আগে এই পথে ৩০ টাকায় যাতায়াত করলেও ই-টিকেটিং চালুর পর থেকে নিয়মিত ২২ টাকা ভাড়ায় যাতায়াত করছেন। আসাদগেইট থেকে মিরপুর-১ আগে ২৫ টাকা ভাড়া নেওয়া হলেও ই-টিকেটিং এ এই পথের ভাড়া ১৩ টাকায় নেমে আসে। শেওড়াপাড়া থেকে ধানমন্ডি-২৭ পর্যন্ত আগে ২০ টাকা ভাড়া নেওয়া হলেও ই টিকেটিং এ পথের ভাড়া ১৩ টাকায় নেমে আসে। রামপুরা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত আগে ২০ টাকা ভাড়া আদায় করা হলেও ই-টিকেটিং এ নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। মিরপুর-১ থেকে গাবতলী আগে ভাড়া ছিল ২০ টাকা ই-টিকেটিং এ নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। মিরপুর-১ থেকে সাভার আগের ভাড়া ৪০ টাকা হলেও ই-টিকেটিং এ ৩০ টাকায় নেমে আসার চিত্র বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, ভাড়া নির্ধারণের শর্ত অনুযায়ী চালক-সহকারীর নিয়োগপত্র, বেতন ও ওভারটাইম নিশ্চিত করা জরুরী। লক্কড়-ঝক্কড় বাস উচ্ছেদ করে, বাসের সার্বিক পরিবেশ উন্নত করে, সিটি সার্ভিস আধুনিক বিশে^র আদলে গড়ে তোলা গেলে, সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করে বাসের জন্য আলাদা ডেডিকেটেড লেইনের ব্যবস্থাসহ নানামুখী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হলে মানুষ ধীরে ধীরে বাসমুখী হবে। মোটরসাইকেলসহ ছোট পরিবহনের উপর নির্ভরশীলতা কমবে, ফলে যানজট ও মানুষের যাতায়াত ব্যয় কমে আসবে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক এড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ই-টিকেটিং উন্নত বিশে^ আগে চালু হলেও গত ৪ বছর আগে বাংলাদেশে চালু হয়েছে। রাজধানীর বাসে ভাড়া নৈরাজ্য দূরীকরণে ই-টিকেটিং চালু করা হয়েছে। ফলে ওয়েবিলের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধের পাশাপাশি বাসে বাসে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে। তিনি আরো বলেন, রাজধানীতে ৩০ নভেম্বরের পর থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস বন্ধ হয়ে যাবে। সকল বাস সার্ভিস দৃষ্টিনন্দন করা হবে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির অপর সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, ঢাকা মহানগরীর বাসে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আমরা নানাবিধ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। আমাদের মহাসচিবের নেতৃত্বে একাধিকবার প্রান্তিক পর্যায়ের বাস মালিকদের নিয়ে সভা হয়েছে। ই-টিকেটিং চালুর পর যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং যাত্রীদের যেসব অভিযোগ আসছে সব অভিযোগ ধীরে ধীরে নিষ্পত্তি করা হবে।

বিআরটিএ’র ঢাকা বিভাগের (ইঞ্জিনিয়ারিং) উপ-পরিচালক স্বদেশ কুমার দাশ বলেন, বিআরটিএ রাজধানীর বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করার লক্ষ্যে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আসছে। আগামীতে এই কার্যক্রম আরো জোরদার করা হবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বেসরকারী মালিকানাধীন সড়ক পরিবহন শিল্পে নি¤œতর মজুরি বোর্ডের সদস্য ইনসুর আলী বলেন, দীর্ঘদিন যাবত নগরীর বাস-মিনিবাস চালক-সহকারীর হাতে দৈনিক ইজারায় চলাচল করত। ই-টিকিট চালুর পর চালক-সহকারী নগদ আয় থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে মজুরি বোর্ড নির্ধারিত হারে বাসের চালক, সুপারভাইজার ও সহকারীর মাসিক বেতন নির্ধারণপূর্বক নিয়োগ পত্র প্রদান ও অতিরিক্ত কাজের মজুরি নির্ধারণ জরুরী।

এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবুল কালাম আজাদ, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ, বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্না, সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব এম মনিরুল হক, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমিতির সভাপতি মনজুর হোসন ঈশা প্রমুখ।