সাতকানিয়ায় যেভাবে মারা গেলেন ১০ নারী-শিশু

:
: ৬ years ago

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের গাটিয়াডেঙ্গা হাঙ্গরমুখ এলাকায় যাকাতের টাকা ও ইফতার সামগ্রী নিতে গিয়ে ১০ নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন শতাধিক নারী-পুরুষ।

সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামের অন্যতম শিল্পগ্রুপ কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মোহাম্মদ শাহজাহানের গ্রামের বাড়িতে তাদেরই প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া মইনুল উলুম দাখিল মাদরাসার সামনে এ ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কবির গ্রুপের পক্ষ থেকে তাদের গ্রামের বাড়িতে যাকাতের টাকা ও ইফতার সামগ্রী দেওয়া হবে বলে আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়। সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও বাশঁখালী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দুস্থ নারীদের হাজির হওয়ার জন্য খবর পাঠানো হয়। খবর পেয়ে উপজেলাগুলো থেকে হাজার হাজার নারী রোববার রাত থেকেই এসে বাড়ির সামনে জমায়েত হন। সোমবার সকাল থেকে উপস্থিত প্রতিজনের মাঝে যাকাতের নগদ এক হাজার টাকা ও এক প্যাকেট ইফতার সামগ্রী বিতরণ শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের ভিড়ও বাড়তে থাকে। ভিড় সামলে যাকাত ও ইফতার সামগ্রী বিতরণে হিমশিম খেতে হয় আয়োজনকারীদের। এ সময় শুরু হয় হুড়োহুড়ি। কে কার আগে ইফতার সামগ্রী নেবে, চলে সেই প্রতিযোগিতা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ ভিড়ের চাপে কয়েকজন নারী মাটিতে পড়ে যান। এ সময় পদদলিত হয়ে কয়েকজন আহত হলে তাদের তুলতে গিয়ে আরও বেশ কয়েকজন নিচে চাপা পড়েন। ওই সময় পদদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই ১০ জন নিহত হন।

নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন- লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর কলাউজান গ্রামের মোহাম্মদ আলাউদ্দীনের কন্যা নুর জাহান বেগম (১৫), আবদুস ছালামের কন্যা টুনটুনি বেগম (১৮), আবদুল হাফেজের স্ত্রী জোস্না বেগম (৫৪), আবদুল করিমের স্ত্রী রহিমা বেগম (৪৫), সাতকানিয়ার খাগরিয়ার মোহাম্মদ ইসলামের স্ত্রী হাসিনা আকতার (৪৫), একই এলাকার নুর হোসেনের স্ত্রী রশিদা আকতার (৫০), চন্দনাইশের পুর্ব দোহাজারীর নুরুল ইসরামের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৬০), বান্দরবান জেলার শুয়ালকের মোহাম্মদ ইব্রহিমের স্ত্রী নুর আায়েশা বেগম (৬০), সাতকানিয়ার ঢেমশার মোহাম্মদ হাসানের স্ত্রী রিনা আকতার (৪০) ও একজন ৩০ বছর বয়সী অজ্ঞাত নারী। এ সময় আরও শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হন। তাদের সাতকানিয়া উপজেলা সদর হাসপাতাল এবং স্থানীয় কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সাতকানিয়া উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নুর অয়েশা (৫০) বলেন, ওয়ার্ড মেম্বারের মাধ্যমে যাকাত ও ইফতার সামগ্রী বিতরণের খবর পেয়ে সোমবার রাতে ১৫ জনের একটি দল গাড়িভাড়া করে গাটিয়াডেঙ্গা পৌঁছান। রাতে কলা ও রুটি কিনে খেয়ে খোলা আকাশের নিচে সারারাত অপেক্ষার পর সোমবার সকালে লাইনে দাঁড়ান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে ভিড়ের চাপে নুর আয়েশা পড়ে গেলে তার হাত ধরে থাকা পুত্রবধূ বুলু আকতার (৩০) হারিয়ে যান। এরপর আয়েশা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তবে এখনও পুত্রবধূ বুলুর খোঁজ পাননি তিনি।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া এলাকার আবদুর রহমানের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম (৪৫) জানান, তিনি আহত হওয়ার পাশাপাশি ঘটনার সময় তার পাশে থাকা ছোট বোন কালু আরা বেগম নিখোঁজ রয়েছেন। ভিড় সামলাতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ থেকে ইফতার সামগ্রী নিতে আসা আবদুস শুক্কুর বলেন, ভিড়ের সময় শুরু হয় ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি আর বিশৃঙ্খলা। এ সময় ভিড় সামলাতে কারো কোনো চেষ্টা ছিল না। এক পর্যায়ে ভিড় বেড়ে লাইন ভেঙ্গে পড়ে। শৃঙ্খলা না থাকার কারণেই এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, আয়োজকদের পক্ষ থেকে ভিড় সামলাতে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।

যাকাত বিতরণ আয়োজনকারী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও যাকাত এবং ইফতার সামগ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। কিন্তু নারীরা লাইনে না থেকে কার আগে কে নেবে- এমন হুড়োহুড়ি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণেই ঘটনাটি ঘটেছে।

ঘটনার পর চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন ও পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধারকাজ তদারক শুরু করেন। এ সময় জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণেই এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। এতবড় আয়োজনে প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। উপজেলা প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কিছু না জানিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এতগেুলো সামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব নেওয়া কোনভাবেই উচিত হয়নি।