সরকারের টানে বেসরকারি ঋণের চাপ কম

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

ব্যয়ের তুলনায় আয় কম। তাই বাজেট ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে সরকার অতিমাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। ফলে প্রভাব পড়ছে বেসরকারি ঋণে। ধারাবাহিকভাবে কমছে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে। এ হার ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বনিম্ন। ওই সময় ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশণ) রাখতে হচ্ছে। আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে তারল্য সংকটে রয়েছে অনেক ব্যাংক। অন্যদিকে বাজেটের ব্যয় ঠিক রাখতে সরকার অতিমাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। যা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমাতে চাপ সৃষ্টি করছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয় বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থ বছরের (জুলাই-জুন) পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ধরলেও শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে।

বেসরকারি খাতের ঋণের বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ঋণের প্রবৃদ্ধি কমার মূল কারণ বেসরকারি খাতে বিনিযোগ হচ্ছে না। ফলে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোরও সমস্যা আছে। বেশকিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট আছে।

তিনি বলেন, উদ্যোক্তাদের ঋণের চাহিদা কমে গেছে। বিগত দিনগুলোতে মূলধনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। শিল্প-কারখানার কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। এসব কিছু দেখে বোঝা যাচ্ছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করছে না। অথবা বিনিয়োগের যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা কাজে লাগাচ্ছে না। যার কারণে ঋণের চাহিদা কম।

সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, একদিকে কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট চলছে। অন্যদিকে সরকার অতিমাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। অর্থবছরের বাজেটের যে লক্ষ্য ছিল ৭ মাসেই তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে। এটিও বেসরকারি খাতের ঋণ কমাতে মূল ভূমিকা পালন করছে।

৯ শতাংশ ঋণ এপ্রিল থেকে বাস্তবায়ন হলেও বেসরকারি খাতে ঋণ তেমন বাড়বে না জানিয়ে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ৯ শতাংশ ঋণ বাস্তবায়ন করতে হলে ৬ শতাংশে আমানত সংগ্রহ করবে। আমাদের মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ৬ শতাংশ তাই কেউ এ রেটে টাকা রাখতে চাইবে না। ফলে আগামীতে আমানত প্রবৃদ্ধিও কমবে। আর আমানত না পেলে ব্যাংক ঋণ দিতে পারবে না। তারমানে ঋণের চাহিদা থাকা সত্তেও ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারবে না বলে তিনি জানান।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে অস্বাভাবিক হারে ঋণ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ৫২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা; আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৫ লাখ ৩৮০ কোটি টাকা। আর ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা নেওয়ার কথা। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম সাড়ে ৭ মাসে লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে ১১০ শতাংশে পৌঁছেছে।

জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলোর উপর মানুষের আস্থা কমেছে। এতে করে প্রত্যাশা অনুযায়ী আমানত আসছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে অর্থ সংকট রয়েছে। এছাড়া অবকাঠামোগত সমস্যা, ঋণের উচ্চসুদহারসহ বিভিন্ন কারণে অনেক উদ্যোক্তা ঝুঁকি নিয়ে ঋণও নিতে চাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে গেছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই অবশ্যই এ অস্থার উন্নতি করতে হবে। এজন্য সরকারকে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নতি করতে হবে। জ্বালানি, অবকাঠামো ও আমলাতান্ত্রিক যে সমস্যা আছে তা সমাধান করা। আর ব্যাংক খাতের মূল্য সমস্যা খেলাপি ঋণ। এটি না কমাতের পারলে কোনো সমাধান হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তুলনায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগের মাস জুলাই শেষে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ।