সম্ভাবনার মহাসড়কে দক্ষিণাঞ্চল

:
: ৫ years ago

পদ্মা সেতুর ৭৫ ভাগ কাজ শেষ। পায়রা বন্দরের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। কলাপাড়ার পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে যাচ্ছে যে কোন দিন। বরিশাল-পটুয়াখালী সড়কের লেবুখালীতে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পায়রা সেতুর নির্মাণ কাজও ৬০ ভাগ শেষ। ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা রেললাইনের সম্ভব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। একই রুটে ফোরলেনের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। বিমান বাহিনীর রাডার স্টেশনের কাজও শেষের দিকে। শেখ হাসিনা সেনা নিবাস উদ্ধোধনের পর সম্প্রসারণ কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে। রয়েছে একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সুর্যাস্ত দেখার বিরল সুযোগের সমূদ্র সৈকত কুয়াকাটা। সব কিছু মিলিয়ে উন্ময়নের মহাযজ্ঞ চলছে এক সময়ের অবহেলিত জনপদ দক্ষিণাঞ্চলে। উন্নয়ন মহাযজ্ঞে জমিজমার দাম বেড়েছে কয়েক গুন। পাল্টে যাচ্ছে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরেই বরিশাল দেশের অন্যতম শিল্পবাণিজের কেন্দ্রে পরিণত হবে আশা ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিকদের।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সবসময় ছিলো অবহেলিত। এ কারণে হয়নি শিল্পায়ন। ফলে কাজের সন্ধানে প্রতিনিয়ত রাজধানীতে ছুটছে মানুষ। টানা তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পরই অবহেলিত দক্ষিণের কলাপাড়ার রামনাবাদ চ্যানেলের তীরে ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর দেশের তৃতীয় পায়রা সমূদ্র বন্দরের ভিত্তি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পায়রা বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এই পায়রা বন্দর ঘিরে ওই এলাকায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়েছে। আগামীতে পায়রা বন্দরের সুযোগ কাজে লাগাতে জমিতে বিনিয়োগ শুরু করেছেন উদোক্তারা। এ কারণে জমির দাম বেড়েছে বহুগুন। বন্দরের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে স্থানীয় সহ দূরদুরান্তের হাজার হাজার শ্রমিক। আগামী ২০২৫ সালে পূর্ণাঙ্গ পায়রা বন্দর চালু হওয়ার কথা রয়েছে।

বন্দরের অদূরে আন্দারমানিক নদীর তীরে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। যে কোন সময় উৎপাদনে যাচ্ছে তারা। এখানে এখনও কাজ করছে দেশী-বিদেশী হাজার হাজার শ্রমিক। আশপাশে আরও দুটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।

পায়রা বন্দরের সুবিধা রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র পৌঁছে দিতে মাওয়া-কাঠালবাড়ি পয়েন্টে নির্মিত হচ্ছে দেশের দির্ঘতম পদ্মা সেতু। ইতিমধ্যে সেতুর ৭৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্য সেতুটি যানচলাচলের খুল দেওয়াই সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

পায়রা বন্দর আর পদ্মা সেতুর যোগাযোগ সহজ করতে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেললাইনের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন অনুযায়ী রেলপথ নির্মাণে রেল লাইন নির্মাণে কর্মপরিকল্পনা আটছে রেলপথ মন্ত্রণলয়।

শুধু রেলপথ নয়, পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা এবং পায়রা বন্দরের যানবাহন চাপ সামলাতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত বতর্মান মহাসড়কের প্রশস্ততা বাড়িয়ে ফোরলেনে উন্নীত করনের জন্য জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম চলছে।

পায়রা বন্দর ও পদ্মা সেতু এবং পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার সীমান্তবর্তী লেবুখালীর পায়রা নদীর উপর এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্ধতির নান্দনিক পায়রা সেতুর নির্মাণ কাজও ৬০ ভাগ শেষ হয়েছে। চলতি বছর যে কোন সময় সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে নির্মাণ কাজ।

বরিশালের ছয় মাইল এলাকায় মহাসড়কের পাশে বিমান বাহিনীর রাডার স্টেশনের কাজও শেষ দিকে। জেলার বাকেরগঞ্জের লেবুখালীতে দেশের সর্ববৃহত শেখ হাসিনা সেনা নিবাস উদ্ধোধন হয়েছে। বর্তমানে এর সম্প্রসারণ কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে।

মহাসড়কের রহমতপুরে অর্ধশত বছরের পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর পাশে সদ্য নির্মিত আধুনিক সেতু সম্প্রতি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। একই মহাসড়কের বাকেরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড ও বোয়ালিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ স্টিল ব্রিজের পাশে দুটি সেতু নির্মাণের কাজও শেষে দিকে।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে এক বিশাল নির্বাচনী জনসভায় ভোলার গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে বরিশালে সরবরাহের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্যাস সরবরাহের সমীক্ষা চলছে বলে জানিয়েছেন বরিশাল সদর আসনের এমপি কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম।

শুধু সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করেই নয়, সম্ভাবনা রয়েছে একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সুর্যাস্ত দেখার বিরল সুযোগের কুয়াকাটা সমূদ্র সৈকতের। কুয়াকাটাকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রে উন্নীত করতে ইতিমধ্যে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে কুয়াকাটার চেহারা।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী বর্তমানে একটি বিদেশী সংস্থায় কর্মরত তারিকুল হক বলেন, নদী বিধৌত দক্ষিণাঞ্চল বরাবর অনুন্নত এবং অবহেলিত ছিলো। প্রধানমন্ত্রী  হাসিনার দূরদৃষ্টির কারণে গত এক দশকে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলে যে উন্নয়ন যজ্ঞ শুরু হয়েছে তার সুফল পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে শুরু করে মাওয়াঘাট পর্যন্ত ৬ লেনের মহাসড়ক হচ্ছে। পদ্মা সেতুর ২০তম স্প্যান বসেছে। পায়রা বন্দরের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ ও রেললাইন হচ্ছে। তাপবিদ্যুত কেন্দ্রও উৎপাদনে যাচ্ছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এবং সরকারের  সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল (এসডিজি) ও মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনে সহায়ক হবে বলে মনে করেন স্থপতি তারিকুল হক।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক পরিচালক বরিশাল চেম্বারের সভাপতি শিল্পপতি মো. সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, ফোরলেন এবং পর্যটন কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের চোখ এখন দক্ষিণাঞ্চলে। ব্যবসায়ীরা দক্ষিণাঞ্চলে প্রাথমিকভাবে জমিতে বিনিয়োগ করছেন। আগামী কয়েক বছরেই দক্ষিণাঞ্চলে অনেক শিল্প কলকারখানা-গার্মেন্ট দৃশ্যমান হবে। তখন লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পাল্টে যাবে মানুষের জীবনমান।

অর্থনীতিবিদ মো. আক্তারুজ্জামান খান বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে সাধারন শিক্ষার হার বেশী থাকলেও কারিগরি এবং প্রযুক্তি শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে দক্ষিণাঞ্চলে কারিগরি এবং প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। ব্লু ইকোনমি কাজে লাগাতে মৎস্য আহরণ ও প্রক্রিয়াজাত, তেল ও খনি, জাহাজ নির্মাণসহ দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য বিষয় ভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন নতুন কারিগরি ও প্রযুক্তি বিভাগ চালু করা জরুরী। তা না হলে প্রয়োজনের সময় দক্ষ জনবল পাওয়া যাবে না। তাই আগেভাগেই দক্ষিণাঞ্চলে কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষার উপর জোড় দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন অর্থনীতির শিক্ষক আক্তারুজ্জামান খান।