সবুজের মেলায় হারের ক্ষতে হৃদয় ছারখার

লেখক:
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে

টাইমস স্কয়ার থেকে নাসাউ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ৪০ কিলোমিটার পথ। গোটা পথই যেন ছেয়ে গিয়েছিল সবুজের মেলায়। লাল সবুজের পতাকা, প্রিয় বাংলাদেশ দলের জার্সি গায়ে নিউ ইয়র্কের সবপথ যেন মিলে যাচ্ছিল শহরের বাইরে গড়ে উঠা নাসাউ স্টেডিয়ামে।

 

 

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই মাঠেই। আগের দিন ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচে ফুল হাউজ গ্যালারি ছিল স্টেডিয়ামে। আজ মাঠ ভরার দায়িত্বটা একাই নিয়ে নেয় বাংলাদেশি সমর্থকরা। গ্যালারি দেখে একটু বোঝা যায়নি ম্যাচটা মিরপুরে হচ্ছিল নাকি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম শহর নিউ ইয়র্কে। গোটা গ্যালারি যেন একখণ্ড মিরপুর!

গ্যালারিতে যেমন প্রাণ ছিল, মাঠের ক্রিকেটেও তাই। চরম রোমাঞ্চকর এখন ম্যাচ হলো। যেখানে হারের ক্ষতে শেষ পর্যন্ত হৃদয় ছারখার হয়েছে লাল সবুজ সমর্থকদের। দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া ১১৪ রান তাড়া করতে নেমে ৪ রানের আক্ষেপে পুড়তে হয় বাংলাদেশকে।

 

নাসাউ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে লো স্কোরিং ম্যাচ হবে তা আগেই জানা ছিল। এই ম্যাচেও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। বাংলাদেশের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৬ উইকেটে ১১৩ রানের বেশি করতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। এই রান তাড়া করতে নেমে একটা সময়ে জয়ের পথেই ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হেরে যায় বাংলাদেশ।

শেষ ওভারে, শেষ বলে নির্ধারণ হয় ম্যাচের ভাগ্য। ৬ বলে বাংলাদেশের দরকার ছিল ১১ রান। দক্ষিণ আফ্রিকা স্পিনার কেশভ মহারাজকে বোলিংয়ে আনে। প্রথম বলটাই বাঁহাতি স্পিনার করেন ওয়াইড। বৈধ প্রথম বলে মাহমুদউল্লাহ নেন ১ রান। পরের বলে জাকেরের ব্যাট থেকে আসে ২ রান। আগের দুই ওভারে কোনো বাউন্ডারি আসেনি বাংলাদেশের ইনিংসে। শেষ ওভারের প্রথম দুই বলে নেই চার-ছক্কা। সমীকরণ তাই কঠিন হয়ে যায় বাংলাদেশের জন্য।

 

তৃতীয় বলে জাকের চেষ্টা চালান। ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলেন শট। কিন্তু টাইমিং মেলাতে পারেননি। বল যায় লং অনে মার্করামের হাতে। নতুন ব্যাটসম্যান রিশাদ ক্রিজে এসে প্রান্ত বদল করেন চতুর্থ বলে। মাহমুদউল্লাহ স্ট্রাইকে যাওয়ায় বাংলাদেশের আশা বেঁচে ছিল। শেষ ২ বলে দরকার ৬ রান। এর আগে এরকম সমীকরণ মাহমুদউল্লাহ মিলিয়েছেন সহজে। আবার ব্যর্থও হয়েছেন। এবার ব্যর্থ হলেন।

মহারাজের লোপ্পা ফুলটস বল লং অন দিয়ে উড়িয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল বল সীমানা পেরিয়ে যাবে। কিন্তু সীমানার কোল ঘেঁষে মার্করাম লাফিয়ে দারুণ দক্ষতায় বল তালুবন্দি করেন। ২৭ বলে মাহমুদউল্লাহর ইনিংস থামে ২০ রানে। আর তার আউটে বাংলাদেশের পরাজয় নিশ্চিতও হয়ে যায়।

শেষ বলে এবার দরকার ছক্কা। এবারও মহারাজের আরেকটি ফুলটস। কিন্তু তাসকিন টাইমিংই মেলাতে পারলেন না। বল বৃত্ত পেরিয়ে গেল। বাংলাদেশ ১ রানের বেশি পেল না। শেষ পর্যন্ত ৪ রানের ব্যবধান বাংলাদেশ ঘুচাতে পারেনি কোনোভাবেই।

 

এই হার যেন কোনোভাবে মেনে নিতে পারেননি তাওহীদ। বিমর্ষ হয়ে বিজ্ঞাপন বোর্ডে মাথা এলিয়ে মুখ লুকাচ্ছিলেন। তাওহীদের মতো গোটা গ্যালারিও এমন পরাজয়ে স্তব্ধ। খুব কাছে গিয়ে এমন হারে সমর্থকদের হৃদয় ছারখার।

ম্যাচটা বাংলাদেশ শেষ দিকে গিয়ে হারলেও ব্যাটিংয়ে পুরোটা সময় ভুগেছে। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতে বিপর্যয়ে বাংলাদেশ। স্কোরবোর্ডে ৫০ রান তুলতে নেই ৫ উইকেট। ৯.৫ ওভারে ব্যাকফুটে বাংলাদেশ। শুরুটা তানজিদ হাসানকে দিয়ে। রাবাদার বলে দুই বাউন্ডারির পর হুট করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন। এলোমেলো ব্যাটিংয়ে রান তোলার চেষ্টায় থাকা লিটন কোনোভাবেই মেলাতে পারছিলেন না টাইমিং। পেসারদের বিপক্ষে ছিলেন নড়বড়ে। স্পিনার কেশভ মহারাজ আসতেই কাভারে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ড্রেসিংরুমে।

 

৫ রানের ব্যবধানে বাংলাদেশ হারায় সাকিব আল হাসানকে। পেসার নরকিয়ের শর্ট বল উড়াতে গিয়ে ক্যাচ দেন মিড উইকেট। এক ওভার পর শান্তও তার পথ অনুসরণ করেন। সাকিব করেন ৩, শান্তর ব্যাট থেকে আসে ১৪ রান। পঞ্চম উইকেটে বাংলাদেশ প্রতিরোধ পায় তাওহীদ হৃদয় ও মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে। ৪৪ রানের জুটি গড়েন তারা। মনে হচ্ছিল তাদের ব্যাটে বাংলাদেশ সহজে লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।

কিন্তু আম্পায়ারের এক সিদ্ধান্তে পুরো ম্যাচ ওলটপালট। শেষ ১৮ বলে বাংলাদেশের দরকার তখন ২০ রান। পেসার রাবাদা ১৮তম ওভার করতে এসে প্রথম বলে পান উইকেটের স্বাদ। তার লেগ স্টাম্পের ওপরের বল তাওহীদের প্যাডে আঘাত করে। আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ আঙুল তুলে তাওহীদকে আউট দেন। সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ নেন তাওহীদ। কিন্তু রিপ্লেতে দেখা যায় বল লেগ স্টাম্পের কোণায়, বেলসে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তৃতীয় আম্পায়ার রিপ্লে দেখে আম্পায়ারের অনফিল্ড সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত ঘোষণা করে।

 

সেখানে থেমে যায় তাওহীদের ৩৪ বলে ৩৭ রানের ইনিংস। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র তাওহীদও চোখে চোখ রেখে লড়াই করছিল। বাকিরা ছিলেন একেবারেই বিবর্ণ। তার আউটের পর পথ ভুলে ম্যাচ হেরে যায় বাংলাদেশ।

সঙ্গে একটি বাই চার নিয়েও আলোচনা হচ্ছে যা নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের পক্ষে আসেনি। ১৭তম ওভারের দ্বিতীয় বলে মাহমুদউল্লাহকে এলবিডব্লিউ দিয়েছিলেন আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে ব্যাটসম্যান বেঁচে যান। কিন্তু বল তার প্যাডে লেগে যায় বাউন্ডারিতে। বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ৪ রান যোগ হওয়ার কথা। কিন্তু আম্পায়ার আউট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বল ডেড হয়ে যায়। তাতে কোনো কিছুই যোগ হয়নি বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে। ওই ৪ রান বাংলাদেশ পেলেও হয়তো এই ম্যাচ হারতে হতো না!

ব্যাটসম্যানরা দলের জয় নিশ্চিত করতে না পারলেও বোলাররা ছিলেন ধ্রুপদী। নতুন বলে পেসার তানজিম ছিলেন দুর্দান্ত। দক্ষিণ আফ্রিকা ২৫ রান তুলতে ৪ উইকেট হারায়। ৩টিই পেয়েছেন তানজিম। রেজা হেনড্রিকসকে এলবিডব্লিউ করার পর ডি কককে বোল্ড করেন। পরে স্টাবসকে সাকিবের হাতে তালুবন্দি করান কাভারে। কেবল উইকেটই নন, বল হাতে সারাশি আক্রমণে তানজিম নাড়িয়ে দেন প্রোটিয়া শিবির। তাকে সঙ্গ দেওয়া তাসকিন পেয়ে যান প্রোটিয়া অধিনায়ক আইডেন মার্করামের উইকেট। তার ভেতরে ঢোকানো বল সহজাত ড্রাইভে খেলতে চেয়েছিলেন মার্করাম। কিন্তু বলের লাইনে ব্যাট চালাতে পারেননি মার্করাম।

সেখান থেকে ক্লাসেন ও মিলার মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে প্রতি আক্রমণে গিয়ে রান তোলেন। তাদের ব্যাটিংয়ের সময়ও ছিল জড়তা। আন ইভেন বাউন্সে তারাও এলোমেলো হচ্ছিলেন। স্নায়ু স্থির রেখে বাজে বল শাসন করে রান এগিয়ে নেন। কিন্তু বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ করার মতো স্কোর তারা পায়নি। ৭৯ বলে ৭৯ রান আসে তাদের জুটি থেকে।

তাসকিন নিজের শেষ ওভার করতে এসে ভাঙেন এই জুটি। ফিফটি ছোঁয়ার অপেক্ষায় থাকা ক্লাসেন তাসকিনের বল উড়াতে গিয়ে বোল্ড হন ৪৬ রানে। ৪৪ বলে ২ চার ও ৩ ছক্কায় সাজান তার ইনিংস। মিলার ৩৮ বলে করেন ২৯ রান। শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে হাল ধরতে পারেননি কেউ। বাংলাদেশের বোলারদের চাপে স্রেফ এলোমেলো হয়ে যায় তাদের ব্যাটিং।

পেস ও স্পিনে সমানতালে আক্রমণ ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ। তিন পেসার তানজিম, তাসকিন ও মোস্তাফিজ ১২ ওভার হাত ঘুরিয়েছেন। ৫৫ রান দিয়ে তারা পেয়েছেন ৫ উইকেট। আর তিন স্পিনার সাকিব, রিশাদ ও মাহমুদউল্লাহ বাকি ৮ ওভারে ৫৫ রানে পেয়েছেন ১ উইকেট।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই ম্যাচে মাত্র এক ওভার হাত ঘুরিয়েছেন সাকিব। ১৭ বছর ও ১২৪ ম্যাচের ক্যারিয়ারে এতো কম ওভার হাত কখনো ঘোরাননি সাকিব। মাহমুদউল্লাহকে অফস্পিনার হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছেন। ৩ ওভারে দিয়েছেন ১৭ রান। স্পিনারদের মধ্যে একমাত্র উইকেট পাওয়া রিশাদ ৪ ওভারে দিয়েছেন ৩২ রান। ইনিংসের শেষ দিকে মিলার যখন মারমুখী হতে যাচ্ছিলেন তখনই রিশাদ তার উইকেট ভাঙেন।

সবকিছুই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। গ্যালারি ভরা দর্শক, দুর্দান্ত বোলিং ও লড়াকু ব্যাটিং। স্রেফ বিজয়ের হাসিটাই হাসতে পারল না। এই গ্রুপ থেকে ৩ ম্যাচে ৩ জয় নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা চলে গেল সুপার এইটে। ২ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ ১টিতে জিতেছে, ১টিতে হেরেছে। বাংলাদেশের আশা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। শেষ ২ ম্যাচে নেদারল্যান্ডস ও নেপালের সঙ্গে জিতলে সহজেই বাংলাদেশ খুঁজে পাবে সুপার এইটের দরজা।