প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত বিশ্ব। স্থবির হয়ে গেছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিলের মতো দেশে লাশের স্তূপ ফেলার পর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখন মৃত্যুপুরী ভারত। জনবহুল এ দেশটির প্রায় সব রাজ্যে এখন মানুষের করুণ আর্তনাদ-হাহাকার। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আতঙ্কে বাংলাদেশও। দেশের করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে, তবু পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। পরিস্থিতির অবনতি হলে তা সামলে ওঠার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই বলে জানাচ্ছেন খোদ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে কঠোর লকডাউন দিয়েও তা বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। একদিকে খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকার তাগিদ, অন্যদিকে মার্কেট-শপিংমল খুলতে ব্যবসায়ীদের চাপ। সড়কে গণপরিবহন নামাতে চাইছেন মালিক-শ্রমিকরাও। জীবন-জীবিকা উভয়ই যখন সঙ্কটে, তখন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
সঙ্কটময় এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবীসহ সব ধরনের সংগঠনের নেতাদের মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তারা সাধ্যমতো সহায়তা নিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছে। আর বেশিরভাগ ব্যবসায়ী সহায়তার পরিবর্তে নিজেদের কর্মীদের বেতন-বোনাস দিতেই সরকারের কাছে প্রণোদনা চাইছেন।
সব পক্ষ সহায়তা নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছানোর দাবি করলেও কার্যত মাঠে দেখা মিলছে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল ও সংগঠনকে। তারা সীমিত পরিসরে মানুষের পাশে দাঁড়ালেও অন্যদের এ বছর এখনো দেখা যাচ্ছে না। গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ে এমপি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ালেও এবার চিত্র ভিন্ন। সবাই যেন নিজে বাঁচার এবং টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপ-কমিটি রাজধানীসহ সারাদেশে খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করছে প্রতিদিন। এবার রোজার শুরু থেকে ভোররাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অনাহারি মানুষকে রান্না করা খাবার দিয়ে আসছে ছাত্রলীগ। বিভিন্ন জায়গায় ইফতার ও খাদ্যসমগ্রী বিতরণ করছে যুবলীগ। এতিমখানায়ও খাবার পাঠিয়েছেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগের নেতাকর্মীদের কৃষকের ধান কেটে বাড়ি তুলে দেয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশের দরিদ্র, অসহায় ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য জেলা প্রশাসকদের সাড়ে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের জরুরি সেবা ‘৩৩৩’-এ কল দিলে অসহায়দের ঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। সেখানে ৫৭৪ কোটি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া করোনাকালের সম্মুখযোদ্ধা সাংবাদিকদের মধ্যে যারা বিপদগ্রস্ত, তাদের সহায়তার জন্য ‘সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে’ ১০ কোটি টাকা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে বিশিষ্টজনরা মনে করেন, প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশে এই সহায়তা যথেষ্ট নয়। সঙ্কটকালীন এ পরিস্থিতিতে সবার এগিয়ে আসা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী সব মানুষের একে-অপরের পাশে দাঁড়ানো উচিত। প্রথমত; সামাজিক সুরক্ষাবিধি শতভাগ নিজে মানা, অপরকে উৎসাহিত করা। দ্বিতীয়ত; গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ, যারা অর্থকষ্টে আছেন তাদের সহায়তা করা। রমজান মাসে সিয়াম সাধনার অংশ হিসেবে গরিবকে সহায়তা করা, আল্লাহকে খুশি করার এটা একটা বড় সুযোগ। নিজেদের আয় থেকে প্রত্যেকটা মানুষকে সহযোগিতা করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের বিষয়ে যদি বলি—দেশ ও মানুষের কাজ করার জন্য রাজনীতি কেন? আমরা সেই ছাত্রজীবন থেকে দেখে আসছি বন্যাসহ নানা দুর্যোগে রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যদিও করোনায় একটা অসুবিধা নিজেকেই নিরাপদে রাখতে হয়। নিজেরই ভীতি তৈরি হয়। তারপরও রাজনৈতিক দলগুলোর আরও করণীয় আছে। শুধু সরকার বা সরকারি দলই করবে, তা নয়। ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগকে দেখছি মানুষের জন্য কাজ করছে। সকল রাজনৈতিক দলের উচিত মানুষের পাশে এগিয়ে আসা।’
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, ‘প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আমরা খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করছি। এই সঙ্কটে আমরা সারাদেশের মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। বিপদের সময় বিত্তবানদেরও নিজ নিজ এলাকায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রতিনিয়ত দাবি করছেন, সরকার ও আওয়ামী লীগ সঙ্কটে মানুষের পাশে থাকলেও বিএনপি সমালোচনায় ব্যস্ত। তারা মানুষের পাশে নেই।
তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘গত ১২ বছর ধরে সরকার দেশকে একদলীয় শাসনের দিকে নেয়া এবং অন্য সব দলকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। দলগুলো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে হঠাৎ চলে এসেছে করোনাভাইরাস। সুতরাং বিরোধী দলগুলো নিজেদের যতটুকু সম্ভব, তারা করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খোদ বিএনপি ২২-২৫ লাখ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির সংসদ সদস্যরা প্রত্যেকে নিজ সংসদীয় এলাকায় ম্যাসিভ আকারে কাজ (করোনা সহায়তা) করেছি। দলের বাইরেও বিএনপির সামর্থ্যবানরা ব্যক্তিগতভাবে তাদের এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।’
রুমিন ফারহানা আরও বলেন, ‘যে দলটি (আওয়ামী লীগ) সব দলকে শেষ করে দিয়ে বিনা চ্যালেঞ্জে ১২ বছর ক্ষমতায়। তারা কী করছে? তারা না হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে পারছে, না বেডের ব্যবস্থা করতে পারছে, না অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে পারছে, না টিকার ব্যবস্থা করতে পারছে? যে টিকা নিয়ে এত বড় বড় কথা শুনেছি, সেটার ব্যবস্থাও করতে পারেনি। টিকা নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ড. এ কে আবদুল মোমেন) বলছেন—‘বেক্সিমকোর চাপে অন্য কোনো দেশ থেকে টিকা আনতে পারিনি’। দেখেন একটা প্রাইভেট কোম্পানির দৌরাত্ম্য কতটুকু বাংলাদেশে? একেকটা প্রাইভেট মাফিয়া কোম্পানি যখন দেশ চালায়, তখন কি আর তার সুবিধা দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যে থাকে? থাকে না।’
এদিকে, বিবৃতিনির্ভর বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বলেছেন, ‘করোনাকালে কর্মহীন, দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা জরুরি হয়ে পড়েছে। অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে সমাজের বিত্তবানদেরও।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রচার সম্পাদক আহমদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘করোনায় মৃতদের দাফন, কৃষকের ধানকাটা ও গরিব অসহায়দের পাশে সাংগঠনিকভাবে আমরা কাজ করছি। ছাত্রসংগঠন থেকে প্রতিদিন ঢাকায় সাহরি ও ইফতার বিতরণ করা হচ্ছে। উপকারভোগীর সঠিক সংখ্যাটা এখন আমাদের হাতে নেই, কর্মসূচি শেষে সারাদেশের তথ্য নিয়ে দিতে পারব।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের দফতর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘দলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ না থাকলেও ঢাকা এবং বাইরে বিভিন্ন এলাকায় নেতাদের নিজস্ব উদ্যোগে সহায়তা কাজ চলছে। আমাদের দল তো বড় লোকদের সংগঠন নয়, দলের কর্মীরাই গরিব, তাদেরই সহায়তা করতে হয়। পাবলিকলি ফোকাস না করে কর্মীদের আমরা সহযোগিতা করছি।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার রাজনৈতিক দলগুলোও বিপর্যয়ের মুখোমুখি। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ অনেক সিনিয়র নেতা মারা গেছেন। এছাড়া বিভিন্ন দলের অসংখ্য নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্য করোনায় আক্রান্ত। ফলে নিজেদের সঙ্কট আর জীবন নিয়েই ব্যস্ত এখন দেশের জনগণের কাণ্ডারীরা।