সংসদ লাইব্রেরি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি এটি। কোটি টাকার সংস্কার করে অত্যন্ত নান্দনিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) কর্নার, দেশি-বিদেশি নতুন পুরাতন সব জাতীয় আন্তর্জাতিক পত্রিকা। আছে সংসদবিষয়ক আইন, বক্তব্য, সংসদের কার্যপ্রণালীসহ সব ধরনের তথ্য। কিন্তু যাদের জন্য এত কিছু সাজানো সেই সংসদ সদস্যদের দেখা নেই। তাদের জন্য কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও সর্বশেষ কোন এমপি ব্যবহার করেছেন তা লাইব্রেরির কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী মনে করতে পারেননি। গবেষণার ব্যবস্থা থাকলেও কেউ এখন আর গবেষণা করছেন না।
গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে মাত্র ২৩ জন এমপি সংসদের লাইব্রেরিতে গেছেন। এই ২৩ জন ৬২ বার এটি ব্যবহার করেছেন। তাদের বেশিরভাগই পত্রিকা পড়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার গেছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। তিনি এক বছরে ১০ বার লাইব্রেরিতে গেছেন। এরপর জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান গেছেন সাতবার। আর আওয়ামী লীগের বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন গেছেন ছয় বার।
কী নেই সংসদের লাইব্রেরিতে
সংসদের লাইব্রেরিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংসদবিষয়ক বই ছাড়াও আইন ও বিচার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্ম, ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ বিভিন্ন দুর্লভ বই আছে। এখানে ডিবেট অব বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি (১৯৩৭-১৯৪৬), ডিবেট অব পাকিস্তান কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (১৯৪৭-১৯৬৯), ডিবেটস অব দ্য ইস্ট পাকিস্তান লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি (১৯৪৮-১৯৬৯), পাকিস্তান গ্যাজেট (১৯৪৮-৭১), ঢাকা গ্যাজেট (১৯৪৮-৭১), বাজেট অব পাকিস্তান, সামারি অব প্রসিডিংস অব দ্য বাংলাদেশ পার্লামেন্ট (১৯৭২-১৯৯৯), অর্ডিন্যান্স, রাষ্ট্রপতির অর্ডারসহ যাবতীয় আইন আছে।
সেখানে ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রধান দৈনিক সংবাদপত্রের সবগুলো সংখ্যাই সংরক্ষিত রয়েছে। সংসদ সদস্যদের জন্য এখানে একটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। এর জন্য ১৬টি কম্পিউটারও কেনা হয়।
২০১৮ সালে জাতীয় সংসদের লাইব্রেরিতে চালু হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার। এই কর্নারের পাশাপাশি রাখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখেই এই দুটি কর্নারে সাজানো রয়েছে সংশ্লিষ্ট বই। তিন কোটি টাকা ব্যয়ে লাইব্রেরি সংস্কার করার সময় এই দুটি কর্নার রাখা হয়েছে। এছাড়া ওই বছর দেশি-বিদেশি ৩০৯টি শিরোনামে ৩৬৫ কপি বই কিনেছে সংসদ। এখন বই ও তথ্য-উপাত্ত প্রায় তিনগুণ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্নারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের অডিও শোনার ব্যবস্থা।
কোটি টাকার প্রজেক্টে লাইব্রেরিতে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ) নামে আরও দুটি কর্নার রাখা হয়েছে। বই যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য রয়েছে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। বইয়ের দীর্ঘ স্থায়িত্বের জন্য বই গ্রহীতার কাছ থেকে বই ফেরত পাওয়ার পর জীবাণুমুক্ত করতে ‘বুক স্টেরিলাইজ মেশিন’র ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়া সংসদ লাইব্রেরির বইয়ের অনলাইন ক্যাটালগের জন্য কোহা লাইব্রেরি সফটওয়্যার ইনস্টল করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কয়েক হাজার বইয়ের ক্যাটালগ ইনপুট দেওয়া হয়েছে। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে লাইব্রেরির ৪০ হাজার বই অনলাইনে ইনপুট করা হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে ই-নিউজ ক্লিপিংস এর কাজ নিয়মিতভাবে চলছে। সংসদ বিতর্ক সার্চের জন্য মার্চ ২০১৪ থেকে ডি স্পেসের (ডিজিটাল রেসপোজিটরি সফটওয়্যার) ব্যবহার শুরু হয়েছে। এই সফটওয়ার ব্যবহার করে অষ্টম ও নবম সংসদের বিতর্ক থেকে যেকোনো তথ্য সার্চ করা যায়।
যেসব এমপি লাইব্রেরিতে গেছেন
লাইব্রেরিতে রাখা এমপিদের উপস্থিতির খাতা থেকে জানা যায়, উপরোক্ত ওই তিনজন ছাড়াও খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন, আহসানুল ইসলাম টিটু, ফেরদৌসী ইসলাম, জাকিয়া তাবাসসুম, হারুনুর রশীদ, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, আরমা দত্ত, রঞ্জিত কুমার রায়, মুজিবুল হক চুন্নু, রানা মোহাম্মদ সোহেল, এ কে এম শাহজাহান কামাল, রুমিন ফারহানা, হাফিজ আহমদ মজুমদার, মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, শহীদুজ্জামান সরকার, ফজলে হোসেন বাদশা, লুৎফুন্নেসা খান, হাবিবে মিল্লাত, ফরহাদ হোসেন ও মোস্তাফিজুর রহমান লাইব্রেরিতে গেছেন।
কোন এমপি কী কারণে গেছেন তাও উপস্থিতি খাতায় লেখা আছে। তাদের বেশিরভাগই পত্রিকা পড়তে গেছেন। কেউ বা বই নিয়ে বই ফেরত দিতে গেছেন। সেই বই ফেরত দেওয়ার বিষয়টিও উপস্থিতি হিসেবে ধরা হয়েছে। আবার কেউবা সংসদে বক্তব্য দেওয়ার জন্য রেফারেন্সের জন্য গেছেন।
এ বিষয়ে সংসদের পরিচালক (লাইব্রেরি ও গবেষণা) মালেকা পারভিন বলেন, ডিজিটাল যুগে এমপিরা এখন নানাভাবে সংসদের সেবা নিয়ে থাকেন। তাদের এখন আর সশরীরে আসতে হয় না। কেউ কেউ বই নেওয়ার জন্য লোক পাঠান। আবার টেলিফোনেও অনেকে বিভিন্ন রেফারেন্স চান। আর তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা তা যোগান দিয়ে থাকি। আবার লাইব্রেরি ব্যবহার করলেও অনেক সময় নাম লেখা হয় না। আর করোনাকালে অনেক দিন সংসদের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এজন্য সংসদ লাইব্রেরিতে উপস্থিতি কম।
কে কতবার লাইব্রেরিতে গেছেন
গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও সরকারি দলের এমপি আবুল কালাম আজাদ ১০ বার, জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান গেছেন সাতবার আর বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন গেছেন ছয় বার। খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন পাঁচবার, আহসানুল ইসলাম টিটু ও ফেরদৌসী ইসলাম চারবার, বিএনপির হারুনুর রশীদ ও জাকিয়া তাবাসসুম তিনবার করে গেছেন। শামীম হায়দার পাটোয়ারী, আরমা দত্ত, রঞ্জিত কুমার রায়, মুজিবুল হক চুন্নু, রানা মোহাম্মদ সোহেল দুই বার লাইব্রেরিতে গেছেন।
আর মাত্র একবার করে গেছেন- এ কে এম শাহজাহান কামাল, রুমিন ফারহানা, হাফিজ আহমদ মজুমদার, মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, শহীদুজ্জামান সরকার, ফজলে হোসেন বাদশা, লুৎফুন্নেসা খান, হাবিবে মিল্লাত, ফরহাদ হোসেন ও মোস্তাফিজুর রহমান।
গত বছরে লাইব্রেরিতে প্রথম যান শামীম হায়দার পাটোয়ারী। আর চলতি ২০২২ সালে প্রথম লাইব্রেরিতে যান আবুল কালাম আজাদ। গত ৯ জানুয়ারি তিনি লাইব্রেরিতে গেলেও এ বছর তার আগে সেখানে আর কোনো এমপি পা রাখেননি।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আবুল কালাম আজাদ এমপির সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে জাতীয় পার্টির এমপি পীর ফজলুর রহমান বলেন, সংসদের গ্রন্থাগারে আইন প্রণেতাদের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের দলিলাদি ছাড়াও তথ্য-উপাত্ত এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। আমি মূলত সেখানে গিয়ে সংসদের আগের বিভিন্ন প্রসিডিংসগুলো পড়ি। এছাড়া বিভিন্ন বই আনি, বই পড়ি। এছাড়া জানার কোনো বিষয় থাকলে সংসদে যে গবেষণা শাখা আছে সেখান থেকে ইনফরমেশন সংগ্রহ করি।
লাইব্রেরি ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে এমপিদের ব্যবহারের জন্য একটি ল্যাব রয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগসহ ডেস্কটপ কম্পিউটার ছাড়াও প্রিন্ট করার ব্যবস্থা আছে। শেষ কবে এই ল্যাব ব্যবহৃত হয়েছে তা কেউ বলতে পারেননি। তাই অব্যবহৃত থাকায় সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কোনো বক্তব্য দিতেও রাজি হননি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও সংসদ বিষয়ক গবেষক নিজাম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের সংসদের মান আর আগের মতো নেই। সেখানে শক্ত বিরোধীদল না থাকায় প্রাণবন্ত আলোচনা হয় না। যুক্তি-তর্কের জন্য পড়ালেখা করতে হয়। কিন্তু এখন প্রতিপক্ষকে গালাগালি দেওয়ায় মুখ্য উদ্দেশ্য। আইন প্রণেতাদের অনেক পড়তে হয়, জানতে হয়। আইন প্রণেতাদের এমন লাইব্রেরি বিমুখতার পেছনে বর্তমান সমাজে বিত্তশালী হওয়ার প্রবণতাই দায়ী। আইন প্রণেতারা এখন জ্ঞানের চর্চা না করে বিত্তশালী হওয়ার চিন্তায় মগ্ন। এটি একটি রাষ্ট্রের জন্য খুবই ক্ষতিকর দিক।