তারেক আহমেদ ॥ অনলাইন নিউজ পোর্টাল যুগ যুগাান্তর ডটকম-এ তথ্যনির্ভর সংবাদ প্রকাশের মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বদলী হলেন বহুবিধ অপকর্মে বিতর্কিত হয়ে পড়া উজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম সরোয়ার। গতকাল রাতে জেলা পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানিয়েছে, গোলাম সরোয়ারকে ঝালকাঠীর নেছারাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে জরুরী ভিত্তিতে বদলী করা হয়েছে। আর নেছারাবাদ থানার ওসি শিশিরকে উজিরপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে উজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সরকারি মোবাইল নম্বরে ফোন করলে ওসি (তদন্ত) হেলাল উদ্দিন রিসিভ করে বলেন, গোলাম সরোয়ার বিশ্রামে আছেন। তিনি জানিয়েছেন, বদলী আদেশের কাগজ হাতে না পেলেও মৌখিকভাবে শুনেছেন।
এদিকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ ওসি গোলাম সরোয়ারের বদলীর খবরে স্বস্তি ফিরে এসেছে উজিরপুরবাসীর মাঝে। গতকাল রাতেই সঠিক সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের এবং জনভোগান্তিকে গুরুত্ব দিয়ে ওসির বিরুদ্ধে তড়িৎ গতিতে অ্যাকশন নেওয়ার জন্য পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন অসংখ্য গুনগ্রাহী ও সাধারণ মানুষ।
অপরদিকে গত ২৬ ফেব্র“য়ারি “খলনায়কের আসনে উজিরপুর থানার ওসি গোলাম সরোয়ার” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে পরদিন ২৬ ফেব্র“য়ারি স্বপক্ষে সাফাই সংবাদ পরিবেশন করান ওসি। গোলাম সরোয়ারের চেয়ার রক্ষায় বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে ওই দালালিমূলক সংবাদ প্রকাশ হলেও শেষ রক্ষা হয়নি তার।
উল্লেখ্য, গত ২৬ ফেব্র“য়ারি যুগ যুগান্তর ডটকম নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদে গোলাম সরোয়ারের নানাবিধ ঘুষ বাণিজ্য, সাধারণ মানুষের সাথে বৈরী আচরণ ও থানার সেবা কর্মকান্ডে খাামখেয়ালীপনার তথ্য তুলে ধরা হয়। ওসির বদলীর কারণ সম্পর্কে জানতে প্রকাশিত সংবাদটি পুনরায় পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলোঃ-
উজিরপুরবাসীর কাছে অস্বস্তির নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে গোলাম সরোয়ার। তিনি ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তার ওসি হিসেবে যোগদানের পর এলাকায় মাদক ব্যবসা, বাল্য বিবাহ, চাঁদা ও দখলবাজি, ভূমিদস্যুতাসহ কোন অপকর্মই রোধ হয়নি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে অপরাধীদের তৎপরতা। উজিরপুরের সর্বত্র কান পাতলেই শোনা যায়, আমরা ওসি’র লোক। যারা এহেন অপকর্ম নেই যা করে বেড়ায় না। এলাকার সাধারণ মানুষের ভাষ্য, চাইলেও সবকিছু বলা যায় না। নিরব দর্শক হয়েই সহ্য করতে হয় নির্যাতন-নিপীড়ন।
এর পূর্বে মুলাদী এবং বানারীপাড়া থানায়ও তিনি ওসি হিসেবে ছিলেন। অজানা ক্ষমতায় বরিশাল জেলা পুলিশের থানাগুলোতেই ঘুরে-ফিরে বিচরণ করছেন তিনি। সম্প্রতি বাবুগঞ্জের একটি নিরীহ পরিবারের সম্পত্তি গায়ের জোরে দখল চেষ্টা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন ওসি। যা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের পর আদালতের বিচারক গোলাম সরোয়ার ও তার স্ত্রী মৌসুমিকে শোকজ নোটিশও জারি করেছেন।
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী কোন কর্মকর্তা নিজ ও অথবা পরিবারের নামে স্থাবর এবং মূল্যবান সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ থাকলেও ওসি গোলাম সরোয়ার অদৃশ্য উপার্জন দিয়ে ক্ষমতার দাপটে বাবুগঞ্জে স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করে চাকরিবিধিকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন।
উজিরপুরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে ওসি গোলাম সরোয়ারের বহু অপতৎপরতার ঘটনা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলেছেন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের আশির্বাদপুষ্ট পরিচয় জাহির করে গোলাম সরোয়ার নিজেকে অতিশয় ক্ষমতাবান ভাবছেন। যা সাধারণ মানুষের সাথে তার আচরণ এবং থানার সেবা কার্যক্রমে প্রকাশ পায়। স্থানীয়রা এও বলেছেন, থানায় ওসি তার কক্ষে বসে সিনিয়র-জুনিয়র কিংবা নারী-শিশু তোয়াক্কা না করে প্রকাশ্যে ধূমপান করেন। অপর একটি সূত্র দাবি করেছে, উজিরপুরের প্রবাসীদের স্ত্রীরা কোন প্রয়োজনে থানায় গেলে ওসি তাদের প্রতি কুনজর দেন। যে বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন আছে। এ বিষয়টিসহ ওসি গোলাম সরোয়ারের নীতিহীন অন্যান্য কর্মকান্ডের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য হাতে এসেছে। যা পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে উজিরপুরের পূর্ব বড়াকোঠা এলাকায় জোরপূর্বক ৯ম শ্রেণির এক স্কুল ছাত্রের সাথে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীর বিয়ে সম্পন্ন করেন তিনি। যা নিয়ে সেখানে বেশ চাঞ্চল্য এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়। একদিকে মেয়েটির তুলনায় ছেলেটি বয়সে ছোট, অপরদিকে ওই কিশোর অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া সত্বেও ওসি খামখেয়ালি করে বাল্য বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। ওই স্কুল ছাত্র পূর্ব বড়াকোঠার বোহরকাঠী এলাকার সত্তার হোসেন ও চম্পা বেগম দম্পতির ছেলে। নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, প্রেমের ফাঁদ পেতে বিয়ে করা এবং মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিচ্ছেদ করাই ওই কলেজ ছাত্রী ও তার পরিবারের পেশা। মেয়েটি পশ্চিম বড়াকোঠার মোঃ কবির হাওয়ালারের কন্যা। সূত্রটি জানায়, ওসি গোলাম সরোয়ার মেয়েটির কাছ থেকে অর্ধ লক্ষের অধিক টাকা ঘুষ নিয়ে ওই বাল্য বিয়ে করিয়েছে স্কুল ছাত্রের পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
অপর একটি সূত্র জানায়, গত বছর অক্টোবর মাসে একজন শিক্ষক তার ছাত্রের সাথে ইয়াবা সেবনকালে আটক হওয়ার পর অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। সূত্র মতে, উজিরপুরের আলী হোসেন মাস্টারের ছেলে বর্তমানে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিলন তারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রের সাথে ইয়াবা সেবন করছিলেন একটি কক্ষে। এলাকাবাসীর সহায়তায় তাদের হাতে-নাতে আটক করে উজিরপুর থানা পুলিশ। মিলনকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর বহু দহরম-মহরম শেষে ৪৭ হাজার টাকা নিয়ে ওই শিক্ষককে ছেড়ে দেন ওসি। যে ঘটনা এলাকাবাসীর মুখে মুখে রয়েছে।
সর্বশেষ ১৯ ফেব্রুয়ারি বরিশালের বাবুগঞ্জের এক পরিবারে ভোগদখলীয় সম্পত্তি আত্মসাতের পায়তারা করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় উজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. গোলাম সরোয়ার ও তার স্ত্রী মৌসুমীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছেন আদালত। ১ম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারক আব্দুল হামিদ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এ নোটিশ জারি করেন। তাদেরকে আগামী ৩৬ দিনের মধ্যে আদালতে কারণ দর্শানের ব্যাখ্যা প্রদানের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
এজাহার সূত্রে জানা গেছে, বাবুগঞ্জ উপজেলার প্রতাপপুর এলাকার মৃত হাবিবুর রহমান খানের দুই ছেলে মো. মিজানুর রহমান ও মো. মহিদুর রহমান খান (টিটু) এবং তাদের নিকটতম আত্মীয় একই এলাকার মৃত মহিউদ্দিন মল্লিক খোকনের স্ত্রী মৌজায় এসএ ২১৭ নম্বর খতিয়ানের ২৬৭, ২৬৯ ও ২৭৩ নম্বর দাগের ৮০৫০ একর সম্পত্তি ২০০৮ সালের ৫ মার্চ স্থানীয় মশিউর রহমান খান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে সাব কবলা দলিলসূত্রে ক্রয় করে তারা বসতবাড়ি ও বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করে ভোগ দখল করছে।
কিন্তু ওই সম্পত্তির কিছু অংশের দাবিদার বরিশালের স্ব-রোড এলাকার মৃত অমল কৃষ্ণ রায়ের দুই ছেলে বিধান চন্দ্র তাপস ও ভাটিখানার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ কুমার রায়ের কাছ থেকে দলিল সইমোহর নকল নিয়ে বাবুগঞ্জের সাব রেজিস্টার ও বরিশালের সাব-রেজিস্ট্রারের যোগসাজশে উজিরপুর থানায় ওসি গোলাম সরোয়ার ও তার স্ত্রী মৌসুমী তাদের জমি থেকে ২০ শতাংশ সম্পত্তি তাদের দাবি করেন।
তবে নিয়ম বর্হিভূতভাবে বিধান চন্দ্র রায় ও বিশ্বজিৎ কুমার রায় ওই সম্পত্তি বিএস খতিয়ানে তাদের নাম রেকর্ড না করিয়ে সাব কবলা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রী করে দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরে ৩১ জানুয়ারি ওসি গোলাম সরোয়ার ও তার স্ত্রী মৌসুমী সম্পত্তি ভোগদখল নেয়ার জন্য জমির মালিকদেরকে হুমকি দেয়।
ওই ঘটনায় ১৩ ফেব্রুয়ারি মো. মিজানুর রহমান খান তার ভাই মো. মহিদুর রহমান খান (টিটু) ও আত্মীয় হোসনেয়ারা বেগম বাদী হয়ে উজিরপুর থানায় ওসি মো. গোলাম সরোয়ার, তার স্ত্রী মৌসুমীসহ ৬ জনকে বিবাদী করে আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত তাদের শোকজ নোটিশ দেয়।
এদিকে সরকারি কর্মকর্তার নামে সম্পত্তি ক্রয় আইনত নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও গোলাম সরোয়ার উজিরপুর থানার ওসি হওয়ায় ক্ষমতার দাপটে সে ও তার স্ত্রী মৌসুমি ওই দলিল সৃজন করেন। সরকারী কর্মচারী (আচরণ বিধিমালা) ১৯৭৯ এর ১১ বিধি মতে সরকারী কর্মচারী কর্তৃক স্থাবর, অস্থাবর, মূল্যবান সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। একই বিধিমালার ৩ বিধিতে বর্ণিত সংজ্ঞায় সরকারী কর্মচারীর পরিবারের সদস্যের মধ্যে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নাম অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
এলাকাবাসীর মন্তব্য, ওসি গোলাম সরোয়ার সরকারি কর্মকর্তা হলেও তার আচরণ রাজনৈতিক নেতাদের মত। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের আশির্বাদপুষ্ট হওয়ার বরাত দিয়ে যাচ্ছে-তাইভাবে থানা পরিচালনা করছেন তিনি। আইনের রক্ষক হয়েও প্রতিনিয়ত তার হাত ধরেই আইন ভঙ্গের মহোৎসব চলছে উজিরপুরে। এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র দাবি করেছে, ওসি গোলাম সরোয়ারের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট বরিশাল পুলিশের উর্ধ্বতন মহল। তার কর্মকান্ডে বিব্রত তারাও।
সার্বিক বিষয়ে বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম তারুণ্যের বার্তাকে বলেন, আইন ভঙ্গকারী যত ক্ষমতাশীলই হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ইতিপূর্বেও পৃথক কারণে গৌরনদী ও কাজীরহাট থানার ওসিদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। উজিরপুর ওসি’র বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।