‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই…’-আবেগ আর দরদভরা গানটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে। তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন সময় দোকানপাট থেকে শুরু করে অন্দরমহলেও বারবার বাজানো হয়, শোনা হয়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির আশপাশে গেলেই গানটি অজানতেই মনে বারবার বেজে ওঠে। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর পরিবার-পরিজন নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম বাড়িটিতে উঠেন।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত সবুজঘেরা তিনতলা সাদা রঙের বাড়িটি যেন শান্তির প্রতীক। প্রবেশ করতেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। বাড়িতে নিচতলায় ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচটি, দ্বিতীয় তলায়ও পাঁচটি রুম এবং তৃতীয় তলায় দুটি কক্ষ রয়েছে। পেছনের দিকে রান্নাঘর এবং পাশে কবুতরের ঘর। বাড়িটি নির্মাণের সময় একতলায় মাত্র দুটি শয়নকক্ষ ছিল। একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু দম্পতি থাকতেন। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় তলায় তার বসবাস শুরু হলে কক্ষটি গ্রন্থাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন বঙ্গবন্ধু। উত্তর পাশের লাগোয়া কক্ষে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা থাকতেন। এ কক্ষেরই একপাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। কিন্তু সেসব আজ ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্তে বাড়িটি ভেসে যায়। ঘাতকদের বুলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব (বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী), শেখ কামাল (বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র), শেখ জামাল (বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র), শেখ রাসেল (বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র), শেখ আবু নাসের (বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছোট ভাই), সুলতানা কামাল খুকু (শেখ কামালের স্ত্রী), পারভীন জামাল রোজী (শেখ জামালের স্ত্রী) প্রাণ হারান। বিশ্বের ইতিহাসে ঘৃণ্যতম এ হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আটজনসহ মোট ৩৩ জনকে হত্যা করা হয়।
বর্তমানে বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন বেশ কয়েকজন। তারা জানান, ২০১১ সালের ২০ আগস্ট বাড়ির উত্তরে সম্প্রসারিত ভবন তৈরি করা হয়। ভবনটির ষষ্ঠ তলায় ২৬টি পর্বে বঙ্গবন্ধুর তথ্য ও সচিত্র ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের সংগ্রামী জীবন তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি বাড়িটি ঘুরে দেখিয়েছেন একজন কেয়ারটেকার। তিনি যখন বাড়িটি সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তার চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে উঠছিল। তার চোখে-মুখে শোকের ছায়া দেখা যায়। কক্ষে কক্ষে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র রয়েছে। প্রতিটি কক্ষেই গুলির চিহ্ন, রক্তের ছাপ। সিলিংয়েও রক্তের সঙ্গে মগজের ছাপ। নিচতলার যে সিঁড়িতে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে রক্তের ছাপ এখনো লেগে আছে। নিচতলায় বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরিতে অসংখ্য বই। দেওয়ালে দেওয়ালে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং অতিথিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তোলা ছবি টাঙানো রয়েছে।
বাড়িটির দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি বেয়ে কক্ষে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে শিশু শেখ রাসেলের প্রিয় অ্যাকুরিয়াম। তাতে বিভিন্ন রঙের মাছ খেলা করছে। দ্বিতীয় তলায় ডাইনিং রুমে রয়েছে চেয়ার-টেবিলসহ সাদাকালো টেলিভিশন। সেখানে আসবাবপত্রসহ দুটি পাত্রে এখনো আচার রয়েছে। পাশেই রয়েছে দুটি সাইকেল। সাইকেলগুলো চালাত রাসেল। বেসিনে তোয়াল ঝুলছে। শেখ রেহানার কক্ষে কাচে ঘেরা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, রাসেলসহ শহিদদের ব্যবহৃত রক্তমাখা পোশাক। বঙ্গবন্ধুর টুপি, চশমা, কুরআন শরিফসহ শখের জিনিসপত্রও সাজানো রয়েছে। আর রক্তমাখা এসব পোশাক বারবার সেই ভোরের ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
যে কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু থাকতেন, সেখানে প্রবেশের সাহস হয়নি। সেখানে বিছানার চারপাশে রক্ত, মেঝেতে রক্ত। সিলিংয়ে রক্তের চিহ্ন। দেওয়ালে গুলির চিহ্ন। দ্বিতীয় তলায় শেখ জামালের কক্ষে শেখ জামাল ও তার স্ত্রীর সাদাসিধে জীবনের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। পুতুল থেকে শুরু করে ক্রিকেট ব্যাট, বল, ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলার সামগ্রীতে কক্ষটি সাজানো। ওয়াশরুমেও একাধিক গুলির চিহ্ন রয়েছে। তৃতীয় তলার উত্তর পাশে শেখ কামালের কক্ষ। এখানে তিনি স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকিকে নিয়ে থাকতেন। তারা যেভাবে কক্ষটি সাজিয়েছিলেন, এখনো সেভাবেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তিনিও সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। তার বিছানার পাশে ১৫ আগস্ট রাতের ব্যবহৃত পানিভর্তি গ্লাস, প্লেট ও চামচ রাখা আছে। ভেতরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নববিবাহিতা স্ত্রী খুকির ড্রেসিং টেবিলে প্রসাধনসামগ্রী অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। কক্ষটির দক্ষিণের জানালার কাচে গুলির চিহ্ন রয়েছে। পাশের একটি কক্ষ বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত আলোচনার রুম হিসাবে ব্যবহার করতেন। ছোট কক্ষটিতে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু একান্তে আলোচনা করতেন। এখানে বসেই তিনি দেশি-বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছিল বাড়িটি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি তার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। সেসময় তিনি তার প্রিয় বাড়িটিতে উঠতে পারেননি। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েও সরকারি বাসায় না উঠে পরিবার নিয়ে বঙ্গবন্ধু ওই বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। বর্তমানে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িটি জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে।
১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সফল নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সিদ্ধান্ত এ বাড়ি থেকেই দেওয়া হতো। ছয় দফা প্রণয়নের আগে এখানে বঙ্গবন্ধু বিশ্বস্ত নেতা ও সুধীজনদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর এ বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যে দিকনির্দেশনা দিতেন, সেই মোতাবেক দেশ পরিচালিত হতো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন ‘সার্চলাইট’ নামে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যা ও গণহত্যা চালায়। এ খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু বাড়ির নিচতলায় তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থেকে টেলিফোনে রাত ১২টা ৩০ মিনিটে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন তিনি। তার স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ওয়্যারলেস ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়।
এ বাড়ি থেকে ২৫ মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস এবং পরে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে। বিজয়লাভের পূর্বপর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িটি দখল করে রাখে। ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটি এখন বাঙালির আবেগ ও ভালোবাসার নাম।
বাড়িটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইয়াসমিন আক্তার জানান, গত বছরের ২৩ মার্চ থেকে বাড়িতে কোনো দর্শনার্থী প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগে এ বাড়ি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসত বাড়িটি দেখতে। তিনি আরও বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক নারী হাতে স্যালাইন এবং গলায় ক্যানোলা নিয়ে বাড়িটি দেখতে আসেন। সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। মারাত্মক অসুস্থ ওই নারী বাড়িটি ঘুরে দেখেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুর আগে বাড়িটি একবার দেখার। এখন মরলেও আমি শান্তি পাব।’