সংকটে নির্মাণ খাত

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

বড় ধরনের সংকটে পড়েছে নির্মাণ খাত। নির্মাণ উপকরণের দাম একটানা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির ফলে সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নকাজে ধীরগতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো নির্মাণকাজে শ্নথগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। নির্মাণ উপকরণের দাম কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে এ খাতের সংগঠনগুলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান পাননি তারা; বরং সময়মতো কাজ শেষ করার চাপে আছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো। দাম না কমলে ১৫ এপ্রিল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি।

গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রডের দাম বৃদ্ধির জন্য মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়। তবে একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে রি-রোলিং মিলস ও স্টিল মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা দাবি করেছেন- সিন্ডিকেট নয়, মূলত পাঁচ কারণে রডের দাম বেড়েছে। কারণগুলো হলো- ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, রডের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, বন্দর সমস্যা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা ইত্যাদি।

দীর্ঘদিনের মন্দা কাটিয়ে কিছুটা গতিশীল হয়ে উঠেছিল আবাসন খাত। ফ্ল্যাট ও প্লটের বেচাকেনা বৃদ্ধিতে উদ্যোক্তারা নতুন করে প্রকল্প গ্রহণ করছিলেন। কিন্তু গত তিন মাসে নির্মাণসামগ্রী রড, সিমেন্ট, পাথর ও ইটের দাম বাড়ায় আবারও সংকটে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। এসব নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি গৃহঋণে ব্যাংক সুদের হার দুই অঙ্কের ঘরে ওঠাও নির্মাণ খাতের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখছে রিহ্যাব। সংগঠনটির মতে, আবাসন খাতে সৃষ্ট সংকটের ফলে ফ্ল্যাটের দাম ২০ থেকে ২২ শতাংশ বাড়তে পারে।

আবাসন খাতকে বাঁচাতে দ্রুত নির্মাণসামগ্রীর দাম ও ব্যাংক সুদের হার কমানোর দাবি জানিয়েছে রিহ্যাব ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি। গত রোববার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সচিবালয়ে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু ওই বৈঠকে নির্মাণ উপকরণের দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেন, রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নয়নমূলক কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, রডের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে কাঁচামালের আমদানি শুল্ক্ক, বন্দরে জাহাজ আনলোড না হওয়ায় বাড়তি ব্যয় ও পরিবহনে খরচ ইত্যাদি বিষয় জড়িত। তাই এ সমস্যা সমাধানে ৬ থেকে ১০ এপ্রিলের মধ্যে অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রথম সভাপতি লিয়াকত আলী ভূূঁইয়া  বলেন, আবাসন খাত আবার সংকটে পড়েছে। এটা নিয়ে সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন তারা। তারা সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতে উল্লেখযোগ্য কোনো লাভ হচ্ছে না। নির্মাণসামগ্রীর দাম না কমলে ফ্ল্যাটের দাম ২০ থেকে ২২ শতাংশ বাড়বে। ফলে বেচাকেনা কমে যাবে। লিয়াকত আলী আরও জানান, এরই মধ্যে অনেকেই নির্মাণকাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছেন। কিছু প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে কাজ করছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মুনীর উদ্দিন আহমেদ বলেন, রড ও সিমেন্টের অস্বাভাবিক দাম কমানোর জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে দাবি জানানো হলেও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। সারাদেশেই নির্মাণকাজে গতি কমে এসেছে। অনেক ঠিকাদার কাজ বন্ধ রেখেছেন। মুনীর উদ্দিন বলেন, যেসব ঠিকাদারের নির্মাণ উপকরণের দর সমন্বয় করার সুযোগ রয়েছে, তারা কাজ করছেন। কিন্তু যাদের সমন্বয় করার সুযোগ নেই, তারা কাজ বন্ধ করেছেন। তারা এখন কাজ করলে লোকসানে পড়বেন। যদিও কাজ শেষ করার চাপ দেওয়া হচ্ছে- সে ক্ষেত্রে ১০০ টন রডের কাজের ক্ষেত্রে ১০ টন রড দিয়ে ধীরগতিতে কাজ চলছে। তিনি বলেন, ঠিকাদাররা চুক্তিতে কাজ করে ৫ শতাংশ মুনাফা পান। কিন্তু শুধু রডের দাম বৃদ্ধিতে ৬ শতাংশের বেশি লোকসান হচ্ছে। এ ছাড়া সিমেন্টসহ অন্য উপকরণের দামও বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, ভারতে প্রতি টন রড খুচরা ৩৮ হাজার ২০০ রুপি বা প্রায় ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আর আমাদের দেশে একই রড ৭২ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ দাম সমন্বয় না হলে স্থবির হয়ে পড়বে নির্মাণ খাত।

বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ  বলেন, রডের কাঁচামাল (মেল্টিং স্ট্ক্রাপট) আমদানিতে সম্প্র্রতি যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শতাংশ কর বাড়িয়েছে। এতে স্ট্ক্রাপের দাম ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে ৪৩০ ডলার হয়েছে। এ কারণে রডের দাম বেড়েছে। গত রোববার বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি রডের দাম কমানোর ঘোষণা দেন। এ কারণে মিল মালিকরা প্রতি টনে রডের দাম মিলগেটে দুই হাজার টাকা কমিয়েছেন। যদিও খুচরা বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। গত বুধবার শিল্প সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সঙ্গে বৈঠকে আরও এক হাজার টাকা কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে তারা আমদানি ব্যয় কমাতে বন্দরে সরাসরি পণ্য খালাসের দাবি জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন শিল্প সচিব।

আন্তর্জাতিক বাজারে দর কম থাকার পরও দেশে এত বেশি দাম কেন- জানতে চাইলে শেখ আসাদুল আলম বলেন, কম দামের পণ্য এখনও আমদানি করা হয়নি। কম দামে আমদানি হলে তখন দাম কমে আসবে। প্রশ্নোত্তরে তিনি আরও দাবি করেন, সিন্ডিকেটে রডের দাম বৃদ্ধির সুযোগ নেই।

দেশের বাজারে গত বৃহস্পতিবার প্রতি টন ৬০ গ্রেডের রড ৭০ হাজার থেকে ৭২ হাজার ও ৪০ গ্রেডের রড ৬৫ হাজার থেকে ৬৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৬০ গ্রেড ৪৫ হাজার থেকে ৪৬ হাজার ও ৪০ গ্রেড ৪০ থেকে ৪১ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি টন রডের দর গড়ে ২৫ হাজার টাকা বেড়েছে। শুধু রড নয়, সিমেন্টের দামও বেড়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতি বস্তা সিমেন্ট ৩৬০ থেকে ৩৮০ টাকা ছিল। এখন তা গড়ে ১২০ টাকা বেড়ে প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৪৭০ থেকে ৫১০ টাকা। এতে সিমেন্টের দর ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

মেটাল বুলেটিনের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহ আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামাল বিলেটের দর কমেছে। এ সময়ে প্রতি টন রডের দাম কমেছে আড়াই হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি টন বিলেট বিক্রি হচ্ছে ৫৩০ থেকে ৫৪০ ডলারে। গত সপ্তাহে চীন থেকে ৫২০ ডলারে বিলেট রফতানির অফার দেওয়া হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি টন বিলেটের দাম পড়ছে ৪৩ হাজার ৬০০ টাকা (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা)। দেশের বাজারে রডের টন এখনও ৭০-৭২ হাজার টাকা। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আগামী মাসের মাঝামাঝি রমজান মাস শুরু। এ কারণে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে রডের চাহিদা অনেক কমতে পারে। ফলে বিলেটের দামও কমবে। তখন দেশের বাজারেও রডের দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।