প্রথম দুই ম্যাচে শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ হারের পর চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ঠান্ডা মাথায় বাংলাদেশের সাংবাদিকদের উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কিভাবে উড়ছে সেটা তো গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো কিভাবে মাটিতে ল্যান্ড করবে- সেটা।’ হাথুরুসিংহে যেন ত্রিদেশীয় সিরিজের শুরু থেকেই দিব্য চোখে দেখছিলেন, শেষ পর্যন্ত অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে। প্রতিপক্ষ নিয়ে তার ভাবনা-চিন্তা কী ছিল সেটা জানা না গেলেও, তার প্রথম চ্যালেঞ্জ যে শ্রীলঙ্কাকে একটি দল হিসেবে গুছিয়ে তোলা ছিল- সেটা ঠিকই বোঝা যায়।
ডিসেম্বরে দলটির দায়িত্ব নেয়ার পর দেড় মাসের মাথায় নিজের দর্শণ আত্মস্থ করিয়ে একটি দলকে মাঠে নামানো এবং সেটার বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো- খুবই কঠিন একটি কাজ। সেটা ভালোভাবেই বুঝেছিলেন হাথুরুসিংহে। যে দলটি ভারত থেকে নাকানি-চুবানি খেয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং কঠিন মনোবল ফিরিয়ে আনার কাজ খুব একটা সহজ ছিল না।
এই কঠিন চ্যালেঞ্জ জয় করতে পেরেছিলেন হাথুরু। লঙ্কান দলটিকে একই সুতোয় গেঁথে ফেলতে পেরেছেন। যে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ অধিনায়কত্ব করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাকে আবার নেতৃত্বে ফিরিয়ে এনেছিলেন। হাথুরু দেখেছিলেন মাঠের নেতৃত্বেও ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার। কিন্তু ইনজুরি সেই ম্যাথিউজকে ত্রিদেশীয় সিরিজের শুরু থেকেই সরিয়ে দিয়েছে লঙ্কান স্কোয়াড থেকে। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক দিনেশ চান্ডিমালের ঘাড়ে গুরু দায়িত্ব।
কিন্তু পরিবর্তিত শ্রীলঙ্কার তাতে মোটেও সমস্যা হয়নি। প্রথম দুই ম্যাচের পরাজয়ের শিক্ষা থেকে এমনভাবে তারা ঘুরে দাঁড়াল যে, সেটা রীতিমত অবিশ্বাস্য। তবে, প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ বলে লঙ্কানদের আত্মবিশ্বাসের যত রসদ অর্জন করা সম্ভব, সবই তারা অর্জন করে নিলো এই সফর থেকে।
প্রথমে ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা জয় থেকে শুরু। এরপর, ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজে ২-০ ব্যবধানে জিতে অর্জনের ষোলকলা পূর্ণ করেই তবে বাংলাদেশ থেকে নিজ দেশের বিমানে উঠতে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা।
চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে নিয়ে তুমুল বিতর্ক। অনেকেরই মতে, তিনি তো একজন কোচই। টাইগারদের প্রতিপক্ষ তার দল। কোচ কখনও পুরো একটি দলের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজের শুরু থেকেই আলোচনায় ছিলেন হাথুরুসিংহে। বাংলাদেশের অন্দরে একটা ভয় আগেই ঢুকে গিয়েছিল, ‘হাথুরু তো আমাদের সব জানেন। খেলোয়াড়দের কোথায় ঘাটতি, কোথায় দুর্বলতা- সবই জানেন। সুতরাং, সেই ঘাটতি এবং দুর্বলতাগুলো ধরে ধরেই তিনি পরিকল্পনা করবেন এবং তার কাছেই হয়তো আমাদের হেরে যেতে হবে।’
অন্দরের এই গোপন কথা কেউ কেউ ফাঁস করে দিলেও ক্রিকেটার থেকে টিম ম্যানেজমেন্টের বর্তমান কর্তকর্তারা জোর গলায় তা অস্বীকার করতে চাইলেন। কেউ কেউ তো বলেই দিলেন, ‘হাথুরু তো আর মাঠে নেমে খেলবে না। খেলা হবে ১১ ক্রিকেটারের সাথে ১১ ক্রিকেটারের।’ ক্রিকেটাররা বারবার বলে যাচ্ছিলেন, হাথুরুর বিষয়টা তারা মাথা থেকেই সরিয়ে দিয়েছেন। এটা নিয়ে ভাবতেই চান না। নিজেদের খেলাটাই খেলতে চান, তাহলে সব শঙ্কা-আশঙ্কা কেটে যাবে।
কেটে যাওয়ার ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন মাশরাফিরা। জিম্বাবুয়েকে ৮ উইকেটে এবং শ্রীলঙ্কাকে ১৬৩ রানে হারিয়ে দিয়ে। যেন প্রবল পরাক্রমে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা প্রমাণ করতে চাইলেন, ‘তোমরা অহেতুক ধারণা কর। একটা জুজু ধরিয়ে দাও আমাদের মনে; কিন্তু দেখো এসব ভয় কিংবা ধারণা-টারনা কিছুই না। আমরা আগের সেই শক্তিশালী দলটিই আছি। কোচ-টোচও এখানে তুচ্ছ।’
হাথুরুর খেল তো এরপরই শুরু হয়েছে। জিম্বাবুয়েকে হারানো দিয়ে। এরপর বাংলাদেশকে ৮২ রানে অলআউট করে হারিয়েছে ১০ উইকেটে। লঙ্কানদের প্রবলভাবে ফিরে আসার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ছিল যেন সেটা। ৮২ রানে অলআউট হওয়ার পরই অন্দরে ঢুকে যাওয়া সেই ভয়টাই আবার ফিরে এসেছে। প্রথম দুই ম্যাচে প্রবল পরাক্রমে উড়তে থাকার পরও সেই ভয়ের রেশ কিন্তু পুরোপুরি মুছে যায়নি। বরং, আরও বেশি ঝেঁকে বসেছে। যার ফলে দেখা গেলো, ফাইনালে লঙ্কানদের ২২২ রানে বেধে ফেলার পরও ৭৯ রানে হারতে হয়। সাকিব ইনজুরিতে পড়েছেন ঠিক; কিন্তু সেটা বড় কোনো অজুহাত হতে পারে না।
দুঃস্বপ্নের সেই শুরু। চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট উইকেট বানিয়ে ব্যাটসম্যানরা ব্যাটে রানো ফোয়ারা ছোটাল। ৫১৩ রান করে সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে। যত দুরই যাক, শ্রীলঙ্কার এই দল তো আর ৫১৩ অতিক্রম করতে পারবে না! সুতরাং, ঢিলেঢালা বোলিং করলেও সমস্যা কী! আদতেই এই মানসিকতা ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিল না কি না জানা নেই। তবে ঢিলেঢালা বোলিং যে হয়েছে তা তো স্কোরবোর্ডই বলে দিচ্ছে। বরাবর ২০০ রান বেশি করে, ৭১৩ রানে গিয়ে ইনিংস ঘোষণা করলো লঙ্কানরা। বাংলাদেশের বোলারদের নাকের পানি-চোখের পানি এক করে ছেড়েছে লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা।
হাথুরুর সাজানো ছকেই চলছিল ম্যাচ। এক্ষণে তার ছকের গুটি কিছুটা ওলট-পালট করে দিয়েছিলেন মুমিনুল হক আর লিটন কুমার দাস। দু’জনের ১৮০ রানের জুটি নিশ্চিত হার থেকে বাঁচিয়ে দিল বাংলাদেশকে। ড্র করে জয়ের স্বাদ নেয়ায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। এরপর, ঢাকা টেস্ট। নিজেকের স্পিনারদের সুবিধার্থে তৈরি করা হলো পুরোপুরি ডেড উইকেট। চার বছর পর দলে ফিরে আবদুর রাজ্জাক পর্যন্ত এখানে ভেল্কি দেখালেন; কিন্তু লঙ্কান দলে যে রঙ্গনা হেরাথের মত বিশ্বসেরা স্পিনার রয়েছেন! সঙ্গে অভিষিক্ত আকিলা ধনঞ্জয়াকে ঠিকমত পড়তেই পারেনি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
১১০ এবং ১২৩ রানে অলআউট হয়ে মাত্র আড়াই দিনেই হেরেছে ২১৫ রানের বিশাল ব্যবধানে। রীতিমত ভরাডুবি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্তঃসার শূন্যতা যেন এর মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়ে গেলো। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, এ অবস্থা থেকে পালালে যেন বাঁচে ক্রিকেটাররা। কিন্তু তার কী কোনো জো আছে! টি-টোয়েন্টি সিরিজ তখনও যে বাকি!
সাকিব আল হাসান হাতের ইনজুরির কারণে এই সিরিজেও খেলতে পারেনি। নেতৃত্ব নিয়ে এখানে একটা তেলেসমাতি কাণ্ডই হলো। অনেকেই চেয়েছিলেন টেস্টে ব্যর্থ মাহমুদউল্লাহর কাঁধে আর দায়িত্ব না দেয়া হোক। তামিম ইকবালকে বাছাই করা হোক। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর ওপরই আস্থা রাখলো টিম ম্যানেজমেন্ট। প্রথম ম্যাচে টস জিতে ব্যাট করতে নামার পর ১৯৩ রান তুলে নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্কোর করার পরই অনেকে জয় লিখে দিয়েছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশের বোলারদের কিভাবে খেলতে হবে সেটা ইতিমধ্যেই নিজের শিষ্যদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন হাথুরু। সুতরাং, ১৯৪ রানের লক্ষ্য লঙ্কানরা পার হলো ২০ বল হাতে রেখেই। সিলেটে শেষ ভাগ্য পরীক্ষা করতে এসে পুরোপুরি ব্যাটিং উইকেটে যখন টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখনই অনেকে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। লঙ্কানরাও প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগিয়ে দিল। ২১০ রানের বিশাল স্কোর গড়ে চ্যালেঞ্জ জানালো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের।
বিশাল রানের নিচে চাপা পড়ে শুরুতেই যেন হার। সৌম্য সরকার শূন্য রানে আউট হওয়ার কারণই এটা- চাপ। অন্যরাও যেভাবে আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাতে ৭৫ রানের পরাজয়ই ললাটে লিখা হয়ে গেলো। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে যে এখানেও লঙ্কানদের নেপথ্যের কারিগর, সেটা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি নিজেই তো একদিন আগে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ অভিজ্ঞতাই আমি কাজে লাগিয়েছি। সত্যি কথা বলতে, অভিজ্ঞতা থাকার কারণে, প্লেয়ার ধরে ধরে পরিকল্পনা সাজাতে পেরেছি। কারণ আমি জানি, চাপে পড়লে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কী করে। সুতরাং, ব্যক্তিগতভাবে বললে, আমার নিজের জন্য অনেক অর্জনের এই সিরিজ।’
হাথুরু কিংবা শ্রীলঙ্কার জন্য অনেক অর্জনের এক সিরিজ যখন, তখন বাংলাদেশের জন্য দুঃস্বপ্নের একটি সিরিজই ছিল এটা। যে দলটি ঘরের মাঠে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মত ক্রিকেট পরাশক্তিকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিল, যারা ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে পরাজয়ের স্বাদ দিয়েছিল, তাদের কতটা অধঃপতন হলে ঘরের মাঠেই ধুঁকতে থাকা একটি দল শ্রীলঙ্কার কাছে এভাবে নাকানি-চুবানি খেতে হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা কোনো এক অশনি সংকেত কি না সেটাও ভেবে দেখা খুব জরুরি।