শেবাচিমে আয়া-বুয়াদের কাছে জিম্মি রোগীরা!

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

শামীম আহমেদ ॥ নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়ায় দিন দিন পরিণত হচ্ছে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতাল। টাকা ছাড়া কোনো নিয়মই এখানে মানা হয় না। সরকারি আওতাভুক্ত না হয়েও অবাধে কাজ করে যাচ্ছে এক দল বহিরাগত কর্মীরা। তাদের ইনকাম একটাই রোগী এবং তাদের অভিভাবকদের হয়রানি করে টাকা আদায় করা। কেউ প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয় না।

অপরাধীদের একটাই কথা, আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো টাকা পাই না। আপনার রোগীর কাজ করছি, টাকা দেন। চাহিদা পূরণ না হলে জোরপূর্বক টাকা আদায় করে থাকেন তারা। সামনে প্রশাসনের লোক থাকলেও তাদের নীরবদর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এছাড়াও জমজমাট ভাবে চলছে আয়া ও ট্রলিম্যানদের কমিশন প্রাপ্ত ডায়গনষ্টিক সেন্টারের দালালি করতে। চিকিৎসকরা রোগীদের রোগ নিধরন করার জন্য রোগীকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়। পরে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের কর্মরত নার্স ও আয়া-বুয়াদের কাছে জিজ্ঞেস করেন এগুলো কোথায় থেকে করবো।

তখনই জামাই আদর শুধু করেন আয়া ও ট্রলিম্যানরা। কৌশলে রোগীর স্বজনদের ভুল বাল বুঝিয়ে নিয়ে যান তাদের কমিশনপ্রাপ্ত নিদিষ্টি ডায়গনস্টিক সেন্টারে। অনুসন্ধানে জানাগেছে, এক জন আয়া ও ট্রলিম্যান প্রতিদিন দালাল নিয়ন্ত্রিত ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন নিচ্ছে ২ হাজার টার উপরে। আর প্রতারিত হচ্ছে দূরদুরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসার সাধারন রোগী ও তার স্বজনরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, হাসপাতাল চক্রে প্রশাসনের লোক রয়েছে। তাদের চোখের সামনেই এসব কর্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে আয়া ও ট্রলিম্যান অথবা ডায়গনস্টিক সেন্টারের দালাল চক্র গুলো।

তারা দেখেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রোগী যতই গুরুতর হোক না কেন টিকেট না কাটলে তাকে কোনো ডাক্তার দেখতে আসেন না। এখানেও পোহাতে হয় ভোগান্তি। গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে আসলে প্রথমেই দূর্নীতির শিকার হতে হয় জরুরি বিভাগে। যেমন ২৬ টাকার পরির্বতে ব্রাদাররা নিচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ব্যস্ততার কারনে ২৬ টাকার পরিবর্তে অতিরিক্ত টাকা দিয়েই চলে যান রোগীর স্বজনরা। রোগীর স্বজনরা টাকার কথা চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি ভর্তি করে নিয়ে ওয়ার্ডে। এরপর শুরু হয় আয়া-বুয়া থেকে শুরু করে সব শ্রেণির কর্মকর্তার দৌরাত্ম্য। হাসপাতালের চারদিকে লেখা রয়েছে দালাল হতে সাবধান। কিন্তু নিয়মকানুন যেন ঠিক এর উল্টো- দালাল ছাড়া কোনো কাজ কল্পনাও করা যায় না। জরুরি বিভাগ থেকে নিদিষ্ট ওয়ার্ডে ভর্তিকৃত রোগীকে নিয়ে গেলে বকশিসের নামে চাঁদাবাজি শুরু করেন ট্রলিম্যানরা।

প্রতিবাদ করলে তাদের হাতে হয়রানীর শিকার হতে হয় রোগীর স্বজনদের। সুত্র জানায়, হাসপাতালের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা নিলেও এরা নিজেরা কাজ না করে বহিরাগতদের কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। রোগীরাও বাধ্য হচ্ছেন, বহিরাগতদের সেবা নিতে। এই সুযোগে রোগীদের জিম্মি করে চাহিদামতো অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আর এ টাকা থেকে হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার এবং নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরাও কমিশন পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব সরকারি কর্মচারী কোনো সেবা দেয়া ছাড়াই মাস শেষে নিয়মিত বেতন তুলছেন। অভিযোগ রয়েছে, এরা হাজিরা দেন শুধু মাত্র নামে। আর এজন্য একজন ওয়ার্ড মাস্টার সরদার ও জমাদারকে প্রতিমাসে দিতে হয় টাকা।

জরুরি বিভাগে কতিপয় কর্মচারি হাসপাতালের ট্রলি দখল করে অর্থের বিনিময়ে রোগীদের ওয়ার্ডে নেয়ার কাজ করছেন। এরা প্রতিদিন প্রতি শিফটে সরদারদেরকে ও ওয়ার্ড মাস্টারকে টাকা দিয়ে হাসপাতালের ট্রলিগুলো দখল করে রোগী ও তাদের স্বজনদের জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বহিরাগত ট্রলি ম্যান জানান, প্রতি শিফটে তিনি প্রায় ৫’শ টার বেশি টাকা আয় করেন। এর থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন তার দেড় থেকে ৩০০ টাকা থাকে। অপরদিকে হাসপাতালকে ঘিরে শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স গাড়িকে কেন্দ্র করে শত শত দালাল নিযুক্ত রয়েছে।

তারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের প্রভাবিত করে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভাগিয়ে নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায় করছেন। এদের কারণে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে রোগী বহন হচ্ছে শুধু মাত্র নামে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির এজেন্ট ও ডায়গনষ্টিক সেন্টারের দালালরা হাসপাতালে নিয়োজিত রয়েছেন হাসপাতালের কোনায় কোনায়। এরা চিকিৎসকদের উপঢোকন দিয়ে তাদের পাশে বসে থেকে ওই কোম্পানির ওষুধ রোগীদের জন্য লিখে দিতে প্রভাবিত করছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ এ নিয়েও এক ধরনের ব্যবসা চলছে হাসপাতালে। দেখা যাচ্ছে, যেসব ওষুধ রোগীদের যথাযথ উপকারে আসছে না সেগুলোও ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেয়া হচ্ছে। এতে রোগীরা প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এসব ব্যাপারে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে ট্রলি ঠেলার নিজস্ব লোকের সংঙ্কট রয়েছে। আর রোগীর চাপ পড়লে অনেক সময় বহিরাগতরা রোগীদের সহযোগিতা করে থাকতে পারে। কিন্তু রোগীদের জিম্মি করা বা অন্য যে কোনো বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। প্রসূতি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন জানান, তার বৌকে ইমারজেন্সি থেকে প্রথমে ট্রলিতে করে ওয়ার্ডে নেয়া হয়। তখন ট্রলিম্যান তার কাছ থেকে জোরপূর্বক ১৫০ টাকা আদায় করেন। ওই একই দিনে তিনতলায় প্রসূতি বিভাগে তাদের সিটের ব্যবস্থার জন্য সেখানে যান। আয়াকেও ৫০ টাকা দেয়া হলে সে হুইলচেয়ারে করে সেখানে আনতে রাজি হয়।

এবং তার বাচ্চা হলে ১ হাজার টাকা দাবি করেন গাইনী ওটির আয়ারা। পরে ৫০০ টাকা দিলে টাকা নিলেও দুরব্যাবহার করে রোগীর স্বজনদের সাথে। টয়লেটেরও খুব নাজুক অবস্থা। গন্ধে ভেতরে ঠোকা যায় না। অনেকে গ্রাম থেকে এখানে আসে কিন্তু গোসলের ব্যবস্থা না থাকায় তাকে বাধ্য হয়ে দিনের পর দিন ওভাবেই থাকতে হয়। পরিস্থিতি এমন যেন রোগীকে সুস্থ করতে এসে নিজে অসুস্থ হয়ে যাওয়া। আরেক রোগীর স্বজন জানান, এখানে সকলে নিরুপায় হয়ে টাকা দিয়ে কাজ করাতে বাধ্য হয়। টাকা না দিলে ট্রলি বা হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরে না। তখন বাধ্য হয়ে যার যার রোগীকে কোলে করে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই একরকম বাধ্য হয়েই তাদের শরণাপন্ন হতে হয় আমারে। তবে রোগীদের প্রশ্ন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের সামনে বড় করে লেখা রয়েছে, দালাল হতে সাবধান।

যেখানে হাসপাতালের কর্মচারীরাই দালালি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে সাবধান করবে কে। হাসপাতালে ভর্তিরত কয়েক জন রোগীর সাথে কথা বলে আরো জানা গেছে বহু অভিযোগ। রোগীর স্বজনরা না বুঝে ডাক্তারের কাছে জানতে গেলে দূরববহার করেন ইন্টানী চিকিৎসকরা। পরে চিকিৎসকদের দমক খেয়ে চলে আসতে হন তাদের। এবং কি অনেক ওয়ার্ডে বড় ডাক্তারের চেহারও দেখেন না রোগীরা স্বজনরা।