শেখ হাসিনার দেড় দশক; ক্রীড়াঙ্গনে দাপট ছিল যাদের

লেখক:
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

আকস্মিকভাবে বদলে গেল দেশের ক্রীড়া জগতের দৃশ্যপট। যারা এক দশকের বেশি সময় ক্রীড়াঙ্গন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তারা এখন অনেকটাই চাপে। টানা এক মাসের আন্দোলনের পর গতকাল সোমবার ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর চলে যাওয়ায় প্রশাসন থেকে শুরু করে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধাক্কা এসেছে।

রাজনৈতিক পালাবদলের পর নানা ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও সরকার পতনের ঝাঁকি লাগছে প্রকটভাবে। দেশের নানা ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও দলীয়করণের মধ্যে ছিল। তাই ক্রীড়াঙ্গনেও পালাবদলের এই সময়ে অপেক্ষা করছে বড় রকমের সব চ্যালেঞ্জ।

দেশের দুই শীর্ষ ক্রীড়া ফেডারেশন ফুটবল ও ক্রিকেট। নাজমুল হাসান পাপন ও কাজী সালাউদ্দিন দুই জনই সভাপতির চেয়ারে এক দশকের বেশি সময়। নাজমুল হাসান পাপন ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির পাশাপাশি সরকার দলের সংসদ সদস্য কয়েক মেয়াদে। এবার ক্রীড়া মন্ত্রীও হয়েছেন। নতুন সরকার গঠন হওয়ার পথে থাকায় পাপনের মন্ত্রীত্ব আর নেই। পাপন মন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই ক্রীড়াঙ্গনের অলিখিত অভিভাবক। হকি, ফুটবলসহ অনেক সমস্যা সমাধান তার দ্বারস্থ হতেন।

পাপন অবশ্য বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি। মেয়াদ পূরণের আগ পর্যন্ত তার স্বপদে থাকার বৈধতা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পালাবদল হলে অনেক সময় স্বেচ্ছায় পদত্যাগের আবার পদত্যাগ করতে বাধ্যও হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডে পাপন অনেকটাই একচ্ছত্রভাবে চালিয়েছেন। ক্রিকেটের অনেক সিনিয়র ও পরীক্ষিত সংগঠক থাকলেও পাপনের আস্থাভাজন হওয়ায় ইসমাইল হায়দার মল্লিকের কর্তৃত্ব মনে করেছেন অনেক।

ক্রিকেট বোর্ডে পরিচালক হিসেবে কয়েকজন রয়েছেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিকভাবে। আবার সাবেক খেলোয়াড় ও সংগঠক হলেও তারাও পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নাজমুল হাসান পাপন ছাড়া বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে আরেকজন এমপি শফিউল ইসলাম নাদেল। অভিষেক টেস্ট দলের সাবেক অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি।

সংসদ সদস্য না থাকলেও ক্রিকেট বোর্ডের অনেক পরিচালক সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র।।আ জ ম নাসির বিসিবির অন্যতম প্রভাবশালী পরিচালক। আরেক পরিচালক গোলাম মর্তুজা সাবেক মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীরের ছেলে।

ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন মন্ত্রী – এমপি হলেও বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। শেখ কামালের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে সদ্য দেশত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সালাউদ্দিনের অনেক পারিবারিক সম্পর্ক। ফুটবলে নানা ব্যর্থতায় কাজী সালাউদ্দিন দেশ জুড়ে সমালোচনায় থাকলেও শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন বলেই ধারণা ফুটবলসংশ্লিষ্টদের৷ তবে কাজী সালাউদ্দিন ২০০৮ সালে সভাপতি হয়েছিলেন সামরিক শাসনের সময়।

বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। বাফুফের আরেক সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহী ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কর্মকর্তা। বাফুফে সদস্য সাইফুল, ওয়াদুদ পিন্টু, হারুনর রশীদ,সত্যজিৎ দাশ রুপু সহ অনেকে আওয়ামী লীগের নানা পর্যায়ের নানা পদে রয়েছেন।

সাবেক ফুটবলার আব্দুস সালাম মুর্শেদী ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷ টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সালাম মুর্শেদীর দুটো হোয়াটসঅ্যাপে একটি মুজিব কোর্ট, আরেকটিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি ছিল। কাল শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ ছবি বদলে ফেলেছেন সাবেক এই ফুটবলার৷ এর বদলে এখন সাধারণ কোর্ট পড়া ছবি দিয়েছেন।

ফেডারেশনেরগুলো কমিটি গঠন হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। ফুটবলে বাফুফে সভাপতি পদে কাজী সালাউদ্দিনের বিপক্ষে ২০১২ ও ২০২০ সালে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি নানা কারণে। কাজী সালাউদ্দিন খানিকটা চ্যালেঞ্জে পড়লেও পাপন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বিনা বাধায় সব সময়।

নির্বাচন ব্যবস্থায় থাকা ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য খেলায় একই অবস্থা। দেশের তৃতীয় বড় খেলা হকির সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ যুব লীগের কর্মী ছিলেন। ক্যাসিনো কান্ডের পর দলীয় পদ বাতিল হয়। এরপরও তিনি আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচীর সঙ্গে ছিলেন।

অলিম্পিকের মূল ডিসিপ্লিন সাঁতার ও অ্যাথলেটিক্স। এই দুই খেলা বেশ কয়েক বছর ধরে দলীয় পরিচয়ের ব্যক্তির কাছেই। সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এমবি সাইফ গোপালগঞ্জ যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার আগে ছিলেন রফিজ উদ্দিন তিনিও দলীয় ব্যবস্থায়। অ্যাথলেটিক্সে কৃতি অ্যাথলেট ও সংগঠকদের সরিয়ে দাপট দেখাচ্ছেন আব্দুর রকিব মন্টু। তিনিও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন।

রোলার স্কেটিং, উশু ফেডারেশনের সেক্রেটারি সরাসরি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ফেডারেশনগুলোর নির্বাচনে যোগ্যতা সামর্থ্যের চেয়ে দলীয় পরিচয় প্রাধান্য হয়ে উঠেছে গত এক দশকে। জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদের সভাপতি আ জ ম নাসির ও মহাসচিব আশিকুর রহমান মিকু বিভিন্ন ফেডারেশন নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

ফেডারেশনগুলোর নির্বাচন প্রক্রিয়ার অন্যতম মাধ্যম কাউন্সিলরশিপ। সেই কাউন্সিলরশিপও হয়ে আসছে দলীয় বিবেচনায় আবার কখনো দল ছাপিয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালীর ব্যক্তির ইচ্ছে অনিচ্ছায়। কাউন্সিলর হওয়ার পর অনেকে নির্বাচনে দাড়াতে পারেননি। কাগজে-কলমে গণতন্ত্র থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের মতো ক্রীড়াঙ্গনের অনেক নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ।

ক্রীড়াঙ্গনে আওয়ামী লীগের সর্বজন গুরু হিসেবে স্বীকৃত মোজাফফর হোসেন পল্টু ও হারুনুর রশীদ। বর্ষীয়ান দুই সংগঠক অবশ্য গত এক দশকে তেমন প্রভাব বিস্তার করেননি। ২০০৯ সালের পর সাবেক দুই ফুটবলার বাদল-টুুটুল ছিলেন সক্রিয়। তারা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সঙ্গী এবং আজীবন আওয়ামী লীগ। ২০১২ সালে পাপন ক্রীড়াঙ্গনে আসার পর তারা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হন৷

দেশের আরেক শীর্ষ সংস্থা বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন। অলিম্পিক এসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা তিন মেয়াদে রয়েছেন। তিনিও শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। অলিম্পিকের মহাসচিব হলেও ক্রীড়াঙ্গনে তিনি তেমন প্রভাব বিস্তার করেননি।

ফুটবল, ক্রিকেট বাদে দেশের বাকি সব ফেডারেশনের সভাপতি সরকার থেকে মনোনীত। হকি, সাঁতারে সামরিক দুই বাহিনীর প্রধান সভাপতি মনোনীত হন। অন্য ফেডারেশনগুলোতে সরকার মনোনীত আমলা, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব মনোনীত করে। সরকার পরিবর্তন হওয়ায় সভাপতি পদে পরিবর্তন আসছে এটা প্রায় নিশ্চিতই।

রাজনৈতিক পালাবদলে ফেডারেশনের রদবদল হয়। সেই রদবদলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন জ্ঞাত। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর বিএনপি সরকার বাফুফের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দেয়। সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে ফিফা বাফুফেকে নিষিদ্ধ করেছিল। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ক্রীড়াঙ্গনের ভবিষ্যতে কি হয় সেটাই দেখার বিষয়।