#

শিশু অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে এতদিন যে নানা রকমের অসঙ্গতি ছিল, সেসব দূর করে রায় দিয়েছেন দেশের উচ্চ আদালতের তিন সদস্যের হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ। আদালত রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘শিশুদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনো সাক্ষ্যগত মূল্যই নেই। অপরাধ যাই হোক, শিশুকে ১০ বছরের বেশি দণ্ড দেয়া যাবে না।’

রায়ের তিনটি সিদ্ধান্ত হলো- শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনো সাক্ষ্যগত মূল্য নেই। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কোনো শিশুকে সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অপরাধ যাই হোক না কেন একজন শিশুকে ১০ বছরের বেশি সাজা নয়।

হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মবিনের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চের বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর রায়টি প্রকাশিত হয় বলে বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) সাংবাদিকদের জানান আইনজীবীরা।

রায়ে যে বিষয়সমূহে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে

ক. শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ জুবেনাইল বিচার পদ্ধতির ধারণার পরিপন্থী।

খ. নিউরোসাইন্স এবং সাইকোলজিক্যাল গবেষণা অনুযায়ী শিশুরা তাদের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল নয়।

গ. শিশুরা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বস্তুত, ব্রেনের যে অংশ আবেগ ও যৌক্তিকতা নিয়ন্ত্রণ করে, শিশু অবস্থায় ব্রেনের সে অংশ পরিপক্ক হয় না।

ঘ. শিশুরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পরিণতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখে না। অনেক ক্ষেত্রে তারা অপরাধের দোষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নেয়।

ঙ. কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা পাওয়ার প্রলোভনে শিশুরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়ে যায়।

হাইকোর্ট তাদের রায়ে মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্টের একটি মামলার রায় পর্যালোচনাসহ বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আদালতের নজিরসমূহ উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের লিখিত আর্টিকেল, বই, সাইন্টিফিক রিসার্চের ফলাফল নিয়েও আলোচনা করে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

সেগুলো হলো

ক. শিশুদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির দণ্ডের ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।

খ. শিশু অপরাধীদের বিচার শিশু আদালতেই হতে হবে। আর অপরাধ যেটাই হোক একজন শিশুকে ১০ বছরের বেশি দণ্ড প্রদান করা যাবে না।

আইনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিশুদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণে দেশে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। তাই শিশুদের শারীরিক ও মানসিক গঠন বিবেচনায় ১৯৭৪ সালের শিশু আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালিত হতো। এর পরে ২০১৩ সালে নতুন শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে শিশুর বয়স, জবানবন্দি গ্রহণ, দণ্ড ও শিশু শোধনাগারসহ বিশেষ বিশেষ বিধান রাখা হয়। এই বিষয়ে দেশের উচ্চ আদালতের পক্ষে-বিপক্ষে রায় ছিল।

সেজন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতির বরাবর আবেদন করা হয়েছিল। ওই আবেদনের ধারাবাহিকতায় বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের তিন সদস্য বিশিষ্ট  বেঞ্চ গঠন করে দেন। সেই বেঞ্চেই শিশুদের নিয়ে যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন।

যেহেতু আইনের জটিল ব্যাখ্যা জড়িত, সেহেতু হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, এম আই ফারুকি এবং শাহদিন মালিককে এমিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে নিয়োগ করেন। তাদের মতামত শুনানি শেষে মামলার রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের অনুলিপি প্রকাশ করা হয়।

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, ‘শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালত এই রায় বিবেচনায় নেবেন। ভারত, যুক্তরাজ্যের উচ্চ আদালতের নজির বিবেচনায় নিয়েই শিশুদের নিয়ে এমন রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।’

উত্তর দিন

Please enter your comment!
এখানে আপনার নাম লিখুন