স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাঙালির আছে নানা দুঃখগাথা। আছে হতাশা। কিন্তু সব আঁধার মাড়িয়ে বাংলাদেশ আজ সোনালি আভায় উদ্ভাসিত। নানা অর্জন আর সফলতায় উবে গেছে সবি দুঃখকথা। দারিদ্র্য আর শিক্ষার অভিধায় ক’বছর আগেও যে জাতিকে চিনতো বিশ্ব, সে জাতিকে আজ চিনছে স্বনির্ভরতায়। বিজয়ের অর্ধশত বছরে অন্য খাতের মতো শিক্ষাখাত নিয়েও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যায় সমানতালে।
লেখক, গবেষক, শিক্ষাবদি ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। শিক্ষার প্রসার নিয়ে আশাবাদী এই বিজ্ঞজন। তিনি বলেন, বিজয়ের ৫০ বছরে এসে শিক্ষার প্রসারতা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেই পারি। প্রথামিক শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক হারে। দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার আলোচনা করা যেতে পারে। একইভাবে নারী শিক্ষা নিয়েও বাংলাদেশ অনেক ভালো করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার ফলাফলে মেয়েরাই ভালো করছে এখন। এটি অবশ্যই ভালো চিহ্ন।
তবে শিক্ষার মান নিয়ে হতাশ এই সমাজচিন্তক। তিনি বলেন, শিক্ষার দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে সরে আসছে। এটি সর্বনাশ করছে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে। শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য জুড়ে গেছে। পুঁজির কাছে শিক্ষা বেচা-কেনা হলে তা আর সাধারণের কল্যাণে আসে না। এখন তাই হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষার মান নেই। যারা পড়াচ্ছেন, তারাও মানহীন শিক্ষা দিচ্ছেন। রাষ্ট্রের উচিত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া। শিক্ষার বিনিয়োগে রাষ্ট্রকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী- দেশে ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৩ এবং ২০০১ সালে ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৮ সালে ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০০৯ সালের হিসাবে ৫৩ শতাংশ।
আর ২০২০ সালের হিসাব মতে দেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ দশমিক শতাংশ। যা আগের বছর ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এক বছরে সাক্ষরতা বেড়েছে দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও করোনাকালে বিপর্যয় ঘটে সর্বত্রই। তবে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী বিশ্ব সংস্থাগুলোও।
বেসরকারি সেবাদানকারী সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অর্থনীতি, শিক্ষা নিয়ে লিখছেন, গবেষণা করছেন। এই গবেষক বলেন, শিক্ষা নিয়ে দুটি বিষয় সামনে আসে। প্রথমত, শিক্ষা নিয়ে সর্বসাধারণের মধ্যে আগ্রহের জায়গাটা জোরদার হয়েছে। একটি দরিদ্র পরিবারেও শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ আছে এখন। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার এক ধরনের বিস্তার ঘটেছে। যদিও এখনো বেশকিছু জনগোষ্ঠী পিছিয়ে আছে।
‘শিক্ষা নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা ঠিক আরেক জায়গায় এবং আমরা সেখানে আটকে আছি। মানসম্মত শিক্ষায় এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। দেশে মানসম্মত শিক্ষার কিছু দ্বীপ আছে এবং নিম্নমানের শিক্ষার মহাসমুদ্র আছে। এই বাস্তবতা নিয়ে বাংলাদেশ ৫০ বছর পারল করলো।’
তিনি বলেন, আগামীতে এই দ্বীপগুলোকে মহাদেশ বানাতে হবে। এটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই কাজটি ঠিক শিক্ষা বিস্তারের মতো না। ধরন ভিন্ন। মানসম্মত শিক্ষার কাজ, চ্যালেঞ্জ আলাদা। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোকে বেশি নজর দিতে হয়, সুশাসন নিশ্চিত করতে হয়। মেধাকে আকৃষ্ট করতে পরিবেশ তৈরি করতে হয়, যা আমরা এতদিনে পারিনি।
‘শিক্ষা নিয়ে আসলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কিছু নেই। শিক্ষা মানুষের অধিকার। সেই অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠা করা গেলো, তা নিয়ে ভাবনার বিষয় আছে। প্রাথমিক ও নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ সফলতার নজির রেখেছে। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে তো যে কেউ-ই প্রশ্ন তুলতে পারেন এবং প্রশ্নগুলো যুক্তিসঙ্গত হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারেলেই শিক্ষা বিস্তারের সার্থকতা আসবে বলে মনে করি।’ যোগ করেন হোসেন জিল্লুর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যে কয়টি খাতে অর্জন হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষা প্রধানতম। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিতে সবার আগে শিক্ষায় গুরুত্ব দেন। বাজেটেও শিক্ষার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করতে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ তাগিদ ছিল। যার ধারাবহিকতায় আজকের সফলতা।
তিনি বলেন, সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে বিশেষ চাহিদা তৈরি হয়েছে। এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না যে, শিক্ষার দরকার নেই। একজন রিকশাচালকও তার কন্যাকে সযত্নে স্কুলে পাঠায়। এটি বড় একটি অর্জন। আর নারী শিক্ষায় যে সফলতা, তা রীতিমতো ঈর্ষণীয় বলে মনে করি। আমাদেরে আগে স্বাধীনতা লাভ করে অনেক দেশই এমন সফলতা আনতে পারেনি। শিক্ষাখাতে নারীর ক্ষমতায়নও ঘটছে। প্রাথমিকে ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষক। সমাজ পরিবর্তনে এই অগ্রগতি অবশ্যই সহায়ক বলে মনে করি।