বিশ্বব্যাপী প্রভাব বাড়াতে চাইছে চীন। বাণিজ্য শক্তি হিসেবে চীন বিশ্বব্যাপী সমীহ অর্জন করেছে আগেই। এই প্রভাব বলয়কে আরও সক্রিয় করে তুলতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগও এখন পুরোনো। বাণিজ্য শক্তি হিসেবে চীনের এই বিস্তার রোধ করতে আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি বাণিজ্য যুদ্ধে নেমেছে। মুখে অবশ্য বলছে ‘দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ন্যায্যতা’র কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসনের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ একে বাণিজ্য-কূটনীতির বদলে বাণিজ্য যুদ্ধ হিসেবেই বেশি চিত্রিত করেছে। কিন্তু এখন এ যুদ্ধ আর শুধু বাণিজ্যের সীমানায় থাকতে চাইছে না। স্নায়ুযুদ্ধের নিয়ম মেনেই এটি সঞ্চারিত হচ্ছে সমর ক্ষেত্রেও।
সামরিক খাতে চীনের ব্যয় বৃদ্ধির খবর অবশ্য নতুন নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে প্রতিরক্ষা বাজেট ফুলে-ফেঁপে উঠতে চাইছে প্রথম বছর থেকেই। এটাও পুরোনো খবর। কিন্তু এই দুই পুরোনো খবরের পালে সম্প্রতি পেন্টাগন যে তথ্যের হাওয়া দিয়েছে, তাতে নড়েচড়ে বসতে হচ্ছে সবাইকে। ১৫ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে পেন্টাগন বলছে, ‘দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রবাহী নৌবহরের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়াচ্ছে চীন। তিন বছর ধরেই চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) সংবেদনশীল সমুদ্রাঞ্চলে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে এসব ভাসমান বিমানঘাঁটি থেকে আমেরিকা ও এর মিত্র এলাকায় হামলা চালানোর জন্য পাইলটদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’
পেন্টাগনের সদ্য প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে এমনকি চীনের স্যাটেলাইট ও পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, ‘চীনের বিমানবাহিনীকে পুনরায় পরমাণু যুদ্ধের মিশনে নিযুক্ত করা হয়েছে। আর এটি হলে চীন প্রথমবারের মতো সমুদ্র, স্থল ও আকাশপথে পরমাণু যুদ্ধ করার সক্ষমতা অর্জন করবে।’
চীনের এই পরাশক্তি হওয়ার উচ্চাভিলাষ বিনা প্রশ্নে পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে এটা বিশ্বের জন্য ভয়াবহ এক সংবাদ। আর আমেরিকার জন্য এটি কত বড় দুঃসংবাদ তা না বললেও চলে। বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ করার পথে এটি বড় বাধা হয়ে উঠতে যাচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন কোনোভাবেই বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে সরে আসতে নারাজ। তারা বরং নতুন নতুন শুল্ক বাধা দাঁড় করাচ্ছে চীনের পথে। তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর প্রশ্নে ভাঙছে চুক্তি। যদিও চুক্তি ভাঙার একই অভিযোগ হোয়াইট হাউসের দিক থেকেও রয়েছে। পাশাপাশি চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের পাল্টা হিসেবে আমেরিকা গ্রহণ করেছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক প্রোগ্রাম, যার লক্ষ্য হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের দুই পারকে অভিন্ন মার্কিন বাণিজ্য স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করা। এই যখন বাস্তবতা, তখন বিবাদ অবশ্যম্ভাবী।
আর এই বিবাদের জন্য সম্ভাব্য সব উপায়ে প্রস্তুত হচ্ছে চীন। সিআইএর উপপরিচালকের ভাষায়, চীন এখন পরাশক্তির কাতারে যুক্ত হওয়াতেই সন্তুষ্ট নয় আর। চীন চায় আমেরিকাকে হটিয়ে সে স্থানটি দখলে নিতে। গত ২০ জুলাই সিআইএ কর্মকর্তা মাইকেল কলিন্স সরাসরিই এ কথা বলেছেন। আসপেন নিরাপত্তা ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে কলিন্স বলেন, ‘তারা যা করছে, আর প্রেসিডেন্ট শি যা বলছেন, তাতে আমি বলব যে তারা আমাদের সঙ্গে মূলত স্নায়ুযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চাইছে। এই স্নায়ুযুদ্ধ আগের স্নায়ুযুদ্ধের মতো নয়। এটি সব অর্থেই স্নায়ুযুদ্ধ। একটি দেশ বৈধ-অবৈধ সব পন্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। লাভের জন্য সরকারি-বেসরকারি, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ব্যবহার করছে শুধু প্রতিপক্ষের ভীত টলিয়ে দিতে, সরাসরি কোনো সংঘাতে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়াই। চীনারা কোনো সংঘাত চায় না। কিন্তু দিন শেষে যখন কোনো স্বার্থ বা নীতি সম্পর্কিত বিষয় আসে, তারা চায় প্রতিটি দেশ আমেরিকা নয়, শুধু চীনের পাশেই থাকুক। চীনারা (বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে) আমেরিকার সঙ্গে ক্রমাগত সংঘাত তৈরি করছে। আর আমরা একে পদ্ধতিগত সংঘাত হিসেবে বিবেচনা করে চুপ করে আছি।’
চীনারা সত্যিই কোনো সংঘাত চায় না। এই শক্তি ক্ষয় না করার নীতি চীনের বড় শক্তি নিশ্চিতভাবেই। আরও বড় শক্তিটি রয়েছে চীনের হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে। বৈরী পরিবেশে চীন বরাবরই নিজের মতো করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর এই ইতিহাসই তাদের পথ দেখাচ্ছে আমেরিকার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে থাকা বাণিজ্য চুক্তি বাতিলের পর ঘুরে দাঁড়াতে। আলিবাবা থেকে শুরু করে চীনা বড় বড় কোম্পানিগুলো মার্কিন দরজা বন্ধের কারণে মাথা কুটে না মরে নতুন গন্তব্য খুঁজে নিচ্ছে। নিজেদের চাহিদা মেটাতে কাজে লাগাচ্ছে নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তিকে।
আর এ কারণেই আমেরিকার শীর্ষ কর্মকর্তারা বারবার চীন সম্পর্কে সতর্ক করছেন প্রশাসনকে। এ ক্ষেত্রে এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার রে ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিচালক ড্যান কোটসের কথা উল্লেখ করা যায়। জাতীয় নিরাপত্তা ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে ক্রিস্টোফার রে বলেছিলেন, ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার মনে হয়, দেশ হিসেবে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড়, বিস্তৃত ও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জটি আসছে চীনের দিক থেকে। আর এটি সর্বতোভাবে করছে তারা। প্রচলিত গুপ্তচরবৃত্তির পাশাপাশি তারা অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তিও করছে। প্রচলিত গোয়েন্দা কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে তারা অপ্রচলিত বিভিন্ন পন্থাও অবলম্বন করছে। এই কাজে মানুষের পাশাপাশি সাইবার পদ্ধতিও ব্যবহার কার হচ্ছে।’
ড্যান কোটস বলছেন, ‘চীন সত্যিই বৈরী প্রতিপক্ষ নাকি আইনসম্মত প্রতিযোগী, সে বিষয়ে আমেরিকার উচিত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া।’ তিনি এ সময় চীনের ব্যবসায়িক গোপন তথ্য থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন গবেষণা চুরির চেষ্টার তীব্র সমালোচনা করেন। বলেন, ‘ঠিক এই জায়গা থেকেই আমাদের ভাবা উচিত।’
পেন্টাগনের প্রতিবেদনের পর এটা পরিষ্কার যে, চীনের দিক থেকে হুমকিটি আর শুধু বাণিজ্য ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। এই হুমকির মাত্রা ঠিক কতটা সে বিষয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক আন্ডারসেক্রেটারি মার্সেল লেটার সিএনএনকে বলেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টির শাসনাধীন এই দেশ নিজ অঞ্চল ও এর বাইরের বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠা করতে আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল ব্যবহার করছে। এগুলোই হচ্ছে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে চীনের গৃহীত বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রধান হাতিয়ার। বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক বাজেট চীনের। দেশটির রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম সেনাবাহিনী, তৃতীয় বৃহত্তম বিমানবাহিনী এবং ৩০০টি রণতরী ও ৬০ টিরও বেশি সাবমেরিনে সজ্জিত শক্তিশালী নৌবাহিনী। এই সবকিছুই এখন হালনাগাদ ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। আমেরিকায় গত এক-দুই দশকে আমরা আমাদের সমরশক্তিকে যেভাবে নবায়ন করেছি, তার দিকে লক্ষ্য রেখেই এই হালনাগাদ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।’
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মে মাসেই চীন নিজেদের তৈরি ৫০ হাজার টন ধারণক্ষমতার যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ উদ্বোধন করেছে। গত ১২ এপ্রিল এই জাহাজ পরীক্ষামূলকভাবে সাগরে চলাচল করে। সেই সময় প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং কমিউনিস্ট পার্টির অধীনেই চীনের নৌবাহিনীকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। একই সময়ে ভারত মহাসাগরে চীন একাধিক সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে, যা এখন জিবুতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে চীন দুটি রণতরী মোতায়েন করেছে, যাতে অবস্থানরত সেনাসংখ্যা অজ্ঞাত। এটিই নিজ সীমানার বাইরে চীনের প্রথম সামরিক ঘাঁটি। গত কয়েক বছরে দক্ষিণ চীন সাগরে চীন বেশ কিছু কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করেছে, যেখানে সামরিক ঘাঁটিও স্থাপন করেছে তারা। এই সব ঘাঁটিতে রাডার থেকে শুরু করে সব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকার কূটনৈতিক শক্তি চীনের চেয়ে এখনো বেশি। কিন্তু ৯/ ১১ ঘটনার পর থেকে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের নজর ঘুরে যায় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার দিকে। কিন্তু চীন এই সময়টাতে শুধু নিজের একক লক্ষ্যে এগিয়ে গেছে। এ কারণেই আজকে আমেরিকার মতো পরাশক্তির সামনে চীন বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্য গত ডিসেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে চীনকে মোকাবিলাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একা নয়, বরং মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বেইজিংকে মোকাবিলার কথা জানিয়েছে আমেরিকা।