কিউবার সিনফুয়েগোস শহরে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু দুর্গম এলাকায় গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। খাবার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। ভয়ানক ক্ষুধা দূর করলেন ক্রমাগত আখের রস খেয়ে। দূর আমেরিকার পাহাড়ি ইয়েলো স্টোন জঙ্গলে তীব্র শীতের মধ্যে তাকে ঘুমাতে হয়েছিল দুটো সোয়েটার আর দুটো জ্যাকেট পরে। বন্যপ্রাণীর আক্রমণের মুখে পড়েছেন; পাহাড়ি পোকামাকড়ের কামড় খেয়েছেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ হাজার ফুট উঁচু পেরুর রেইনবো মাউন্টেন অভিযাত্রার সময় তিন-তিনবার শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েও তিনি সাহস হারাননি। বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন সেই পাহাড়ে।
এমন চমকপ্রদ ও শিহরণ জাগানো সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নাজমুন নাহার হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী নারী পরিব্রাজক। সৃষ্টি করেছেন নতুন ইতিহাস। গত ১৭ বছর বলতে গেলে একা একাই চষে বেড়াচ্ছেন সারা পৃথিবী। দেশ-দেশান্তর ভ্রমণের অদম্য নেশায় ইতিমধ্যে তিনি ঘুরেছেন ৯৩টি দেশ। ভেসেছেন সমুদ্রে, উঠেছেন বহু সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গে। ঝুঁকি থাকার পরও গিয়েছেন ক্যারিবীয় সাগরে যুক্তরাজ্যের কয়েকটি ঔপনিবেশিক দ্বীপপুঞ্জে। এ মাসেই দেশভ্রমণে সেঞ্চুরি করবেন তিনি- দুই চোখ ভরে উঠবে ১শ’টি দেশ দেখার আলোয়।
ভারতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নাজমুন নাহার শুরু করেছিলেন তার পরিভ্রমণ। সুইডেনে থাকেন তিনি। শেষ ভ্রমণ করেছেন গত বছর নিউজিল্যান্ডে। তার ভ্রমণের ঝুলিতে নিউজিল্যান্ড ৯৩তম দেশ। এর পর ভ্রমণে বিরতি দিয়ে গত ডিসেম্বরে তিন মাসের জন্য দেশে আসেন। ঘুরে বেড়ান সারাদেশ। তরুণ-তরুণী ও শিশুদের ভ্রমণে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অনাথ আশ্রমের বাসিন্দা, এমনকি পথশিশুদেরও শুনিয়েছেন তিনি তার বিশ্বভ্রমণের গল্প। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি কাতারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছেন। কাতার থেকে তিনি তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তানসহ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করে ইউরোপ হয়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে যাবেন। এর পর দেশে ফিরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভুটান ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তিনি শততম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক গড়বেন।
বাংলাদেশের কথা বিশ্ববাসীকে জানাতেই তরুণী নাজমুন নাহারের এই স্বপ্নযাত্রার শুরু। ‘যে পথে তুমি একা সেই পথে তুমি পাবে বহু পথিকের দেখা’- এ দর্শনকে সঙ্গী করে ঘর থেকে বাইরে পা ফেলে একের পর এক দেশ ভ্রমণ করে চলেছেন তিনি। ভ্রমণের কথা বলতে গেলেই তার চোখ স্বপ্নাতুর হয়ে ওঠে- ছোটবেলায় রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে জোছনা রাতে একা একা বারান্দায় বসে চাঁদের আলো দেখতাম। কখনও বাড়ির সামনের ফুলবাগানে হেঁটে বেড়াতাম। রাতের প্রকৃতির সঙ্গে আনমনে কথা বলতাম। তিনি জানান, বাংলাদেশের নারীরা বিশ্বে অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী। তাদের মনোবল, পরিশ্রম ও প্রকৃতি দেখার অনাবিল নেশাই তাকে অনুপ্রাণিত করেছে পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে চলতে।
কী করে নাজমুন নাহারের মনে ভ্রমণের স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল? সে কথা জানতে চাইতেই তিনি বললেন, ছোটবেলায় বাবার কাছে নানা ভ্রমণকাহিনী শুনেছেন তিনি। তা ছাড়া তার দাদা আলহাজ ফকীহ মৌলভী আহাম্মদ উল্লাহও ছিলেন ভ্রমণপিপাসু মানুষ। কখনও ঘোড়ায়, কখনও জাহাজে- এভাবে আরবের অনেক দেশই ভ্রমণ করেছেন তিনি। দু’জনের ভ্রমণপ্রীতি ঠাঁই পায় তার অবচেতনে। আর তাতে গতি আনে ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়ার নেশা। দেশ-বিদেশের ভ্রমণকাহিনী আকর্ষণ করতে থাকে তাকে। বইয়ের পাতা থেকে বিভিন্ন দেশ নাজমুনকে হাতছানি দিয়ে ডাকে বিশ্বজয়ের পথে এগিয়ে যেতে।
তিনি বলেন, ‘দারুচিনি দ্বীপের দেশে’ ভ্রমণ কাহিনীটি তার মনে খুব দাগ কেটেছিল। বিদেশের বিভিন্ন লেখকের ভ্রমণ কাহিনীও তাকে অনুপ্রাণিত করে। বিশেষ করে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’, জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দ্য রোড’, এরিক উইনারের ‘দ্য জিওগ্রাফি অব ব্লিস’, সুজানা রবার্টসের ‘অলমোস্ট সাম হয়্যার’, চেরিল স্টেরয়ডের ‘ওয়াইল্ড’ ও ট্রাভেল ব্লগার্সদের ব্লগ ভীষণভাবে উৎসাহিত করে তাকে।
নাজমুনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর সদরের গঙ্গাপুরে। বাবা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিন না ফেরার দেশে চলে গেছেন বেশ আগেই। আর ঘর সামলানো মা তাহেরা আমিনও সম্প্রতি ভ্রমণসঙ্গিনী হন তার। মাকে নিয়ে তিনি ভ্রমণ করেন সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকার ১৪টি দেশ। আট ভাইবোনের মধ্যে নাজমুন সবার ছোট। শিক্ষাজীবন পার করেছেন নন্দনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, দালাল বাজার নবীন কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে। এ সময় সুইডওয়াচসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় খ কালীন চাকরি করেন তিনি। প্রতি মাসেই কিছু টাকা জমিয়ে তা সম্বল করে পা বাড়ান নতুন কোনো দেশের দিকে। জাহাজে ভ্রমণ করেন ফিনল্যান্ড। কখনও একা, কখনও দল বেঁধে বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণে যান। সম্মেলনকে কেন্দ্র করেও ভ্রমণে যান নাজমুন। এখনও অনূঢ়া নাজমুন নাহার একা ভ্রমণ করলেও কখনোই নিজেকে একা মনে করেন না।
নাজমুন বাংলাদেশ স্কাউটের গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশন থেকে ভারতের পাঁচমারি সফরের মধ্য দিয়ে বিদেশ ভ্রমণের শুরু তার। চিলির আতাকামা, আর্জেন্টিনার মেন্দোজা সিটি, উরুগুয়ের পুন্টা ডেল এস্তা, ব্রাজিলের ফোজ দু ইগুয়াজু, জ্যামাইকার ট্রেন্স টাউন, ডোমিনিকান রিপাবলিকের সাওনা আইল্যান্ড, মেক্সিকোর কানকুন, আইসল্যান্ডের ল্যান্ডমান্নালুগার, অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, পানামা সিটি, নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট কুক, গ্রিসের সান্তোরিনি আইল্যান্ড, মন্টিনিগ্রোর কট্টর, বসনিয়ার বিষ্যেগ্রাদ শহর, সুইজারল্যান্ডের উন লাউটারবার্ন ভিলেজসহ উল্লেখযোগ্য অনেক স্থানেই পরিভ্রমণ করেছেন তিনি।
নাজমুন বলেন, ভ্রমণে নানা প্রাকৃতিক ও পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এগোত হয়েছে তাকে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। তবুও তিনি বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেন। তিনি বলেন, একা ভ্রমণ করলে আপনি শিখবেন কীভাবে সব পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়; কীভাবে প্রতিকূল পরিবেশকেও জয় করা আর জীবনের স্বাধীনতাকে উদ্যাপন করা যায়।
স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষায় লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলা নারী নাজমুন বলেন, বিশ্বের সব দেশেই নারীরা নিজ নিজ যোগ্যতা ও সাহসিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়েছে। ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে আরও অনেক দূর যেতে হবে। আত্মবিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের মনের উদ্দামতাকে কাজে লাগাতে হবে।