পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে/ জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/ এই বাংলায়/ তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।/
কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতা একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালি জাতির জীবনে। ৪৮ বছর আগে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ১৬ ডিসেম্বরে এসেছিল বাংলার স্বাধীনতা। এই দেশে উদিত হয়েছিল নতুন এক সূর্য। সে সূর্য কিরণে লেগে ছিল রক্ত দিয়ে অর্জিত বিজয়ের রঙ। সেই রক্তের রঙ সবুজ বাংলায় মিশে তৈরি করেছিল বাংলার লাল সবুজ পতাকা। যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের সাতই মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে জাতিকে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা নত করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য অস্ত্র সমর্পন করেছিল বাঙালি জাতির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরব ও অহংকারের দিন। দীর্ঘ নয় মাস বিভীষিকাময় সময়ের পরিসমাপ্তির দিন। লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তস্রোত, স্বামী-সন্তানহারা নারীর অশ্রুধারা, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, আর বীরাঙ্গনাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে অর্জিত হয়েছিল মহান এই বিজয়। ৪৮ বছর আগে এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিল আত্মপরিচয়ের ঠিকানা।
আজ কৃতজ্ঞ জাতি সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করবে দেশের বীর সন্তানদের। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশ নেবে বিজয় দিবসে। বিজয়ের ৪৮ বছর পেরিয়ে এবার ৪৯তম বিজয় দিবস। এবারের বিজয় দিবস এসেছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। আগামী ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী এবং এর পরের বছর ২০২১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ।
মহান বিজয় দিবসে ঊপলক্ষে পৃথক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান যৌথবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব, মুক্তিযোদ্ধাদের উপ-অধিনায়ক এ কে খন্দকার প্রমুখ। দুপুর একটার পর জেনারেল হেড কোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পনের দলিল তৈরির বৈঠক। এক পক্ষে নিয়াজি, ফরমান আলী ও জামশেদ। অপর পক্ষে জ্যাকব, নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী। সিদ্ধান্ত হয় দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী বাহিনীর পক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডিং ইন চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং বিজিত বাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কামান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিমান ও নৌবাহিনীর চিফ অব স্টাফসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। নিয়াজি অভিবাদনসহ অভ্যর্থনা জানান যৌথ বাহিনীর কমান্ডারকে।
বিকাল পৌনে পাঁচটায় পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে এলেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও বিজিত সৈনিকরা শেষবারের মত জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়। বিকাল পাঁচটায় জেনারেল নিয়াজি ও যৌথবাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরা এগিয়ে গেলেন ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। জেনারেল অরোরা বসলেন টেবিলের ডান দিকের চেয়ারে। বাম পাশে বসলেন জেনারেল নিয়াজি। দলিল আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। জেনারেল অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজির দিকে। তখন বিকাল পাঁচটা ১ মিনিট। নিয়াজি দলিলে স্বাক্ষর করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে। দীর্ঘ নয়মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙ্গালী জাতির জীবনে এলো নতুন প্রভাত। এলো হাজার বছরের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। বাঙালি জাতি অর্জন করলো তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার।