ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ। সস্ত্রীক ঢাকা থেকে বরগুনায় ফিরছিলেন ওই লঞ্চে। অনেক যাত্রীর পাশাপাশি ভাগ্যক্রমে তিনি এবং তার স্ত্রীও তীরে ভিড়তে পেরেছেন।
বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) গভীর রাতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চটিতে ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। দগ্ধ বা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন শতাধিক মানুষ।
বিভীষিকাময় সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ। তিনি বলছিলেন, ‘রাত আড়াইটার দিকে লঞ্চের ইঞ্জিনে আগুন ধরে। হয়তো ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল অথবা ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা ছিল। পাশেই পাঁচটি গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সব মিলিয়ে ওখানে আগুন ধরে।’jagonews24
‘এরপর (ইঞ্জিনে যারা ছিল) তারা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তারা বিষয়টি গোপন রাখে, কাউকে জানায়নি। অন্য কারও সাহায্যও নেয়নি। যাত্রীদেরও জানায়নি। অন্তত ২০-২৫ মিনিট যখন হয়ে গেছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি, যখন দেখেছে আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে, তখন ঘোষণা দেয় যে যার মতো বেরিয়ে যান, বাঁচুন, ইত্যাদি..।’
ইউএনও মুজাহিদ নিজের অবস্থা নিয়ে বলছিলেন, ‘রাত ৩টার সময় রুম বয় আমার দরজায় ধাক্কা দিয়ে জানায় যে, লঞ্চে আগুন লেগেছে, নামেন।’
‘তখন কোথায় নামবো? নামার তো উপায় নেই। আমি ছিলাম দ্বিতীয় তলায় কেবিনে। আগুন লেগেছে নিচ তলার ইঞ্জিনে, এক কর্নারে। আমি তখন কেবিন থেকে ড্রেস পরে বের হয়ে আসি। তখন দেখি প্রচণ্ড ধোঁয়া। তখনও আগুন সম্পূর্ণ লাগেনি, সামনের দিকে ছড়ায়নি। কিন্তু ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে সবকিছু।’
হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ বলেন, ‘লঞ্চের প্রায় সবাই ঘুমে ছিল। ঘুম থেকে উঠে লঞ্চের দোতলার ডেকে দাঁড়াই। সেখানে প্রায় এক থেকে দেড়শো লোক দাঁড়ানো। আরও অনেকে ভেতরে, পেছনে ছিল। সেখানে এত ধোঁয়া যে ধোঁয়াতে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার যেটা মনে হয় যে এই ধোঁয়াতেই অনেক মানুষ অজ্ঞান হয়ে গেছে বা মারা গেছে। তখন আমি চিন্তা করলাম যে এখানে থাকলে হয়তো বাঁচা যাবে না। যদিও আগুন সে পর্যন্ত আসেনি, তবে ধোঁয়াতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
‘এর প্রায় ১৫ মিনিট পরে আমার স্ত্রী এবং আমি, রেলিং ক্রস করে লাফ দিয়ে নিচ তলার ডেকে পড়ি। স্ত্রী আগে লাফ দেয়। এতে তার পা ভাঙলেও সেসময় বুঝতে পারেনি। একই রকম স্পেস সেখানেও। সেখানে প্রায় ৪৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘লঞ্চ তখন মাঝনদীতে ছিল। তখন যাদের হয়তো শক্তি সামর্থ্য আছে বা যারা অভ্যস্ত তারা লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে এবং সাঁতরে পাড়ে ওঠার চেষ্টা করে। সে সময় যারা পেরেছে তারা সাঁতরেই পাড়ে গেছে। সেখানে উদ্ধারকারী নৌকা বা ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো নৌকা সেভাবে দেখিনি।’
‘এ সময় লঞ্চে আটকা পড়ে যায় মূলত তারা যাদের বাচ্চা আছে। কারণ বাচ্চা নিয়ে তারা লাফ দেওয়ার সাহস পায়নি। বাচ্চাকে বাঁচাবে নাকি নিজে বাঁচবে? কিন্তু পরে যখন আগুনের তীব্রতা বাড়ে তখন যারা পেছনে ছিল বা ভেতরে ছিল, তারা আর ভিড় ঠেলে সামনে আসতে পারেনি। তারা সেখানে আগুনে দগ্ধ হয় বা ধোঁয়ায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।’
বিভীষিকার বর্ণনা দিয়ে মুজাহিদ বলেন, ‘আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে অনেকে লাফ দিলেও আমি লাফ দেইনি। আমি অপেক্ষায় ছিলাম যে, কোনো একটা সাহায্য আসবে বা লঞ্চটা তীরে ভিড়বে। কিন্তু কোনো সাহায্য-সহযোগিতা আসেনি। সেখানে তখন একটা বীভৎস দৃশ্য। মানুষের আহাজারি, দোয়া-দুরূদ...সে পরিস্থিতি বর্ণনা করার মতো না।’
ভয়াবহতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘তখন অবস্থা এমন যে ডানে আগুন, বামে পানি। এখন কোথায় মরবো? এমন অবস্থা। এ অবস্থার মধ্যে ৪টা বাজার ৫-১০ মিনিট আগে, ৩টা ৫০-৫৫ মিনিটের দিকে, একেবারেই সৌভাগ্যক্রমে, আল্লাহ জীবনটা বাঁচাবেন, একেবারে আল্লাহর রহমত, লঞ্চটা স্রোতের টানে দুলতে দুলতে একেবারে তীরে চলে আসে। আমার মনে হয় না যে ইঞ্জিনের কারণে এটা হয়েছে। কারণ ইঞ্জিন তো আরও আগেই বিকল হয়ে গেছে।’
‘লঞ্চটা তীরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গেই লোকজন আমরা যারা সামনে ছিলাম, তারা নেমে আসি। এরপরই লঞ্চটায় বিকট শব্দে আগুন ধরে যায় এবং সেটি ভস্মীভূত হয়ে যায়। সে দৃশ্যটা বীভৎস। যারা তখনও ভেতরেই ছিল, তারা সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছে।’
‘এরপরে ওখান থেকে স্ত্রীকে কোলে করে নিয়ে ট্রলারে তুলি। ট্রলার নিয়ে বরগুনা হাসপাতালে যাই। সেখানে আগুনে পোড়া মানুষের বীভৎস দৃশ্য। বর্ণনাতীত দৃশ্য’—বলেন ইউএনও মুজাহিদ।
ঘটনাস্থলে র্যাব, বিআইডব্লিউটিএ, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড ও ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ড তদন্তে একাধিক কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন। তাদেরও লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাথরঘাটার আগে পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মুজাহিদ। এর আগে তিনি বান্দরবানের এনডিসি পদেও দায়িত্ব পালন করেন। বান্দরবানে থাকাকালে হোসাইন মোহাম্মদ মুজাহিদ সবার নজর কেড়েছিলেন জেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলো নতুনরূপে সাজিয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে। নীলাচল, প্রান্তিক লেক, বনপ্রপাত, চিম্বুক, নীলদিগন্তসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলোর প্রতিটিতে আছে তার ছোঁয়া। এসব জায়গায় লাগিয়েছেন অসংখ্য গাছ। সেই ধারা অব্যাহত ছিল ইন্দুরকানী উপজেলায়ও। অল্প কয়েকদিনে তার কাজ, সততা, নিষ্ঠা দিয়ে জায়গা করে নেন উপজেলার মানুষের হৃদয়ে। বদলির আদেশ এলে প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধনও করেন উপজেলাবাসী।
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com