আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রতি ‘অতি জরুরি’ ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জোরদার করার যে দাবি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তা অত্যন্ত যৌক্তিক ও ন্যায্য। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, এ সংকট প্রশ্নে প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশকে মর্মাহত করেছে। এ ব্যাপারে অতি দ্রুত কিছু করতে ব্যর্থ হলে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মহাবিপদে পড়বে। প্রত্যাবাসনে অগ্রগতির ঘাটতির কারণে হতাশা বৃদ্ধি পাওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এবং তারা অতি সহজে জঙ্গি মতাদর্শের শিকার হচ্ছে। এটি পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য সম্পূর্ণ বাস্তবভিত্তিক। রোহিঙ্গা সংকটের চার বছর পার হলেও তাদের প্রত্যাবাসনে নেই কোনো অগ্রগতি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থানজনিত সংকটটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। জাতিসংঘেও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গারও প্রত্যাবাসন হয়নি।
মিয়ানমারে বর্তমানে প্রায় যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ফলে সংকটটি নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। মিয়ানমারের জেনারেলরা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতেই ব্যস্ত, রোহিঙ্গা সংকট এখন তাদের অগ্রাধিকারে নেই। একই কারণে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়টিও স্থবির হয়ে পড়েছে।
ওদিকে আফগানিস্তানের রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের কারণে নতুন করে আফগান শরণার্থী ইস্যু সামনে চলে আসায় আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন আর তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এক বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলো হলো- ১. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবার জোরালো প্রচেষ্টা চালানো; ২. প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অনিশ্চয়তা দূর করতে মিয়ানমারে রাজনৈতিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটানো; ৩. আসিয়ানের দায়িত্ব ও জোরালো প্রচেষ্টা; ৪. রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও তাদের ধারণক্ষমতার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে জাতিসংঘ ও অংশীদারদের মিয়ানমারে বিভিন্ন স্পষ্ট পদক্ষেপ ও প্রকল্প গ্রহণ এবং ৫. রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো।
আমরা আশা করব, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো প্রধানমন্ত্রীর এসব পরামর্শ আমলে নিয়ে দ্রত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তাদের অনুধাবন করতে হবে-মিয়ানমার বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আগ্রহী নয়। গত চার বছরে তাদের ট্র্যাক রেকর্ড তা-ই বলছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর একটাই উপায় আর তা হলো মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এই চাপ হতে হবে কার্যকর। মনে রাখা দরকার, আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে অন্তর্বর্তী রায় দিলেও মিয়ানমার তাতে গা করেনি।
বস্তুত মিয়ানমার এক চরম স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির ধার ধারছে না। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর চাপের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের সক্রিয় ভূমিকা কাম্য। প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানকেও যুক্ত করতে হবে।