রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা রাখছে না মিয়ানমার

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

উখিয়া-টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্পসহ বিভিন্ন এলাকায় নতুন-পুরাতন মিলে প্রায় ১১ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরকে সরকার ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা নিয়মিত মানবিক সহায়তা প্রদান করছে। তারপরও রোহিঙ্গাদের মাঝে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বাসনা কাজ করছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কূটনৈতিক তত্পরতা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেও মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না বলে জানান একাধিক রোহিঙ্গা নেতা। উপরন্তু মিয়ানমার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নানা বৈঠক ও আলোচনায় দেওয়া অঙ্গীকার পালন করছে না মিয়ানমার। প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।

গত বছরের ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন শুরু হলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দলে দলে রোহিঙ্গারা এদেশে পালিয়ে আসে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের নেপিডোতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে ২৩ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কার্যক্রম শুরু করার জন্য উভয়পক্ষ একমত হয়। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ৮০৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লে. চ সোয়ের হাতে তুলে দেন। এসময় বাংলাদেশ সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থানরত সাড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জোর দিলে মিয়ানমার বিষয়টি পরবর্তীতে আলোচনা সাপেক্ষে জানানো হবে বলে আশ্বস্ত করে।

২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়ায় বৈঠক করে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরবর্তী ২ সপ্তাহের মধ্যে শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হবে। এরপর উভয় দেশের প্রতিনিধিদল শূন্যরেখা পরিদর্শন করে। এসময় রোহিঙ্গা নেতারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ নাগরিকত্বসহ ৬ দফা দাবি তোলে।

এদিকে, পহেলা মার্চ সকাল থেকে হঠাত্ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ, বাংকার খনন, ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে মিয়ানমার সৈন্যরা সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি করে। বিজিবি পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানায়। পরদিন বেলা সাড়ে ৩টায় বাংলাদেশের ভেতরে  পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিবেশের কথা বললে মিয়ানমার তা পুরোপুরি অস্বীকার করে। অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ নিয়মিত টহলের অংশ বলে বিষয়টি তারা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সর্বশেষ উভয়পক্ষ আগামী ২৭ মার্চ দু’দেশের সীমান্তরক্ষী পর্যায়ের যৌথ টহলের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বৈঠকে শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গাদের আবারো ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেও এ পর্যন্তও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

গতকাল শনিবার সকালে উখিয়ার বৃহত্তম রোহিঙ্গা ক্যাম্প কুতুপালং বস্তির নেতা আবু ছিদ্দিক, সেক্রেটারি মোহাম্মদ নূর জানান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া সফর ও নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের সাথে মতবিনিময় করার পর রোহিঙ্গাদের মাঝে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার সেনাদের সীমান্তে বেপরোয়া আচরণ, দফায় দফায় ফাঁকা গুলিবর্ষণসহ বিভিন্ন হুমকি-ধমকির কারণে এখানকার রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

শূন্যরেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গা নেতা মৌলভী আরিফুল্লাহ জানান, শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গারা গ্যাঁড়াকলে পড়েছে। এদিকেও আসতে পারছে না, সেদিকেও যেতে পারছে না। যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সিদ্ধান্ত মিয়ানমার সেনারা মানছে না। তারা রাতের বেলায় এসে সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে চলে যাওয়ার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে।

প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্মসচিব) আবুল কালামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন ও শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

কক্সবাজার নতুন জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন মোবাইল ফোনে জানান, প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক হলে সাংবাদিকদের জানানো হবে।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল মনঞ্জুরুল হাসান খান জানান, সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। মিয়ানমার জিরো পয়েন্টে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে ফেরত নেওয়ার কথা জানালেও  কখন, কিভাবে ফিরিয়ে নেবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম সরওয়ার কামাল বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। মিয়ানমার সেনা, বিজিপি, নাটালা বাহিনীর ভয়ভীতিতে যেসব রোহিঙ্গা শূন্যরেখা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল তারা ক্যাম্পে পুনরায় ফিরে এসেছে।