মাত্র চার ম্যাচ হয়েছে। এর মধ্যে সেরা ম্যাচ হওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু পর্তুগাল-স্পেন ম্যাচটি যদি বিশ্বকাপ শেষেও সেরা ম্যাচ নির্বাচিত হয়, তবে প্রশ্ন তোলার সুযোগ মনে হয় না থাকবে। যে ম্যাচের প্রতি মুহূর্তে টান টান উত্তেজনা, প্রতি মুহূর্তে কী হয়, কী হয় একটা ভাব, যে ম্যাচে কে কখন এগিয়ে যাচ্ছে, কে সমতা টানছে সেটা বুঝতেও একটু সময় নিতে হচ্ছে, সে ম্যাচকে ৬০ ম্যাচ আগেই সেরা ম্যাচের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া যায়। এমন অবিশ্বাস্য এক ম্যাচেরই জন্ম দিল দুই আইবেরিয়ান প্রতিবেশী। যে ম্যাচে কেউ হারলেই সেটা অন্যায় হতো, সে লড়াইটা শেষ হয়েছে ৩-৩ গোলের মহাকাব্যিক এক সমতায়।
এ জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। ম্যাচ শুরু হওয়ার চার মিনিটের মাথায় প্রথম গোল, ম্যাচ শেষ হওয়ার মিনিট চার-পাঁচ আগেও শেষ গোলও তাঁর। এর মাঝে ডেভিড ডি গেয়ার দেওয়া একটা উপহারও বুঝে নিয়েছেন দারুণভাবে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বয়সে হ্যাটট্রিকের কথাও যদি ভুলে যেতে চান, তবে ৮৮ মিনিটে দেওয়া তাঁর ফ্রিকিকটা ভুলবেন কীভাবে? আগের মতো আর ফ্রিকিক নিতে পারেন না বলে আওয়াজ উঠছে সবদিক থেকে। এমন অবস্থায় ডি-বক্সের বাইরে ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে নিজের আদায় করা ফ্রিকিক।
বলটা আকাশে তুললেন। পিকে-বুসকেটসের লাফিয়ে ওঠা শরীরকে টপকাল সে বল। গোলবারের বাইরে দিয়ে যাওয়ার ভান করতে করতে সে বল শেষ মুহূর্তে বাঁক নিল, আচমকা নিচু হয়ে ঠিকই জালে ঢুলে গেল। হতভম্ব ডি গেয়া শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, এ প্রজন্মের সেরা খেলোয়াড়দের একজন কীভাবে বিশ্বকাপের মঞ্চকেই নিজেকে প্রমাণের জন্য সেরা উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিলেন। প্রথম মিনিট থেকেই রোনালদো আজ যেন সেটাই দেখাতে নেমেছিলেন!
স্পেন ধীরলয়ে খেলতে পছন্দ করে। টিকিটাকার ছন্দে হঠাৎ একটা টান তোলে আর সেটা দ্রুতলয়ে রূপ নেয়। পর্তুগিজরা আজ সে সুযোগটা দিতে চাইল না। ম্যাচের বলের প্রথম টোকা স্পেনের, তবু বলটা কেড়ে নিতে দেরি হলো না পর্তুগালের। গনসালো গেদেস ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো মিলে দ্বিতীয় মিনিটেই একটা সুযোগ পেলেন। কিন্তু একটু বেশি সময় নিয়ে ফেলায় ডান প্রান্তের সে আক্রমণ ব্যর্থ হলো।
সেটা পরের মিনিটে বাঁ প্রান্তে আরেক আক্রমণ দিয়ে পুষিয়ে দিলেন রোনালদো। বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢোকার মুখে তাঁর পায়ের একটু কারিকুরিতে বিভ্রান্ত হলেন নাচো। ট্যাকলটা একটু দেরিতে হলো, পেনাল্টি! ৪ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে বিশ্বকাপের খাতা খুললেন পর্তুগিজ অধিনায়ক। প্রথম কোনো পর্তুগিজ হিসেবে চার বিশ্বকাপে গোল হলো, হলো টানা আট আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে গোল করার অনন্য এক রেকর্ডও।
এরপরও যে স্পেন ম্যাচে ফিরেছে সেটা বলা যাচ্ছিল না। বিশ্বকাপে স্পেনের সবচেয়ে বয়সী দলের ধীর গতির সুযোগ নিয়ে বারবার আক্রমণে উঠছিলেন গেদেস, রোনালদো ও বার্নার্দো সিলভা। ১৭ মিনিটে গেদেসকে গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন রোনালদো। কিন্তু গেদেসের শট ঠেকিয়ে দিয়েছেন জর্ডি আলবা।
২২ মিনিটেই ব্যবধান বাড়াতে পারত পর্তুগাল। দারুণ এক প্রতি আক্রমণে স্পেন রক্ষণকে অসহায় বানিয়ে দিয়েছিলেন গেদেস ও রোনালদো। বাঁ প্রান্তে থাকা রোনালদো পাস বাড়িয়ে দিলেন ব্রুনো ফার্নান্দেসের দিকে। অবিশ্বাস্যভাবে সে গোল হাতছাড়া করেছেন ফার্নান্দেস। ২ মিনিট পরেই এর মূল্য চুকিয়েছে পর্তুগাল। নিজেদের স্বভাবগত ছোট ছোট পাসের কথা ভুলে পর্তুগালের ডি-বক্সের কাছে থাকা ডিয়েগো কস্তাকে লম্বা এক ক্রস দেওয়া হলো। সে বল দারুণভাবে শুধু নিয়ন্ত্রণই নেননি এই স্ট্রাইকার, ছিটকে ফেলে দিয়েছেন সঙ্গে থাকা ডিফেন্ডার পেপেকে। তারপর ডি-বক্সের ভেতর ঘিরে থাকা দুই ডিফেন্ডারকে বডি ডজে বোকা বানিয়ে দূরের পোস্টে শট, গোল! দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে এসে গোলে নিজের প্রথম শট, তাতেই গোল কস্তার (১-১)!
২৬ মিনিটে ইসকোর শট ক্রসবারে লেগে ফিরে না এলে স্পেন এগিয়েও যেতে পারত। এর পর স্পেন রীতিমতো ছড়ি চালিয়েছে। আক্রমণে আক্রমণে তটস্থ করেছে পর্তুগালকে। কিন্তু গোল পেল পর্তুগাল! ৪৪ মিনিটে রোনালদো গোলে একটি নিরীহ শট নিয়েছিলেন, সেটা ডি গেয়ার ভয়ংকর এক ভুলে গোল হয়ে গেল। জমজমাট এক প্রথমার্ধ শেষ হলো ২-১ ব্যবধানে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আবার ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ স্পেনের কাছে। সেটা কাজে এল ৫৫ মিনিটে। বক্সের বাইরে থেকে এক ক্রস ডান পোস্টে পেয়ে হেড করলেন। সে হেড গোল লাইনের সামনে থাকা কস্তার কাছে। গোল, সমতায় ফিরল স্পেন (২-২)।
২ মিনিট পরে পাপ মোচন হলো নাচোর। ইসকো, সিলভার পায়ের কারুকাজ থেকে পাওয়া বল যখন ভেস্তে যাবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু বক্সের বাইরে বল পেলেন নাচো। ডান পায়ের জোরালো বাঁকানো শট। সেটা ঝাঁপিয়ে পড়া রুই প্যাত্রিসিওকে ফাঁকি দিয়ে পোস্টে লেগে উল্টো দিকের জালে (৩-২)। ম্যাচের তখনো ৩২ মিনিট বাকি!
এরপরই স্পেন একটু খেলায় ঢিল দিল। আর পর্তুগালও ম্যাচে ফেরার প্রয়াস পেল। আর সেটা পূর্ণতা পেল রোনালদোর সুবাদে। ৮৬ মিনিটে তাঁকে আটকাতে গিয়ে জেরার্ড পিকে বক্সের বাইরে ফাউল করলেন। এরপর তো সেই অসাধারণ গোল। যে গোলে অমরত্ব পেয়ে গেলেন রোনালদো। সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক, হ্যাটট্রিক এনে দেওয়া গোলেই ছুঁয়ে ফেলেছেন ফ্রাঙ্ক পুসকাসকে। ৮৪ গোল করে ইউরোপে গোলদাতাদের চূড়ায় আছেন এখন দুই যুগের দুই গোল মিশন।