রুদ্র অয়ন’র উপন্যাস “তদন্ত”

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

উপন্যাস 
তদন্ত 
রুদ্র অয়ন
এক
ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে  ছিটিয়ে আছে বেশ কতক পত্র পত্রিকা। একখানা সংবাদপত্র হাতে নিয়ে তাতে চোখ বোলাতে লাগলো সজীব।
বড় বড় হেড লাইনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
‘শহরের নিউ মার্কেটে চাঞ্চল্যকর ডাকাতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে চোখ আটকে গেলো সজীবের। প্রতিবেদনটির সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে – গতকাল রাত দশটার সময় শহরের নিউ মার্কেটের অনুপম জুয়েলার্সের মালিক জিম রহমান দোকান বন্ধ করতে উদ্যত হয়েছেন ঠিক সেই মুহূর্তে একদল ডাকাত আতর্কিত হামলা চালিয়ে তার দোকান থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণে চুনী বসানো দামী হার চুরি করে পালিয়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ যে, উক্ত হারটি ডেপুটি কমিশনার (ডি.সি) সাহেব তাঁর একমাত্র মেয়ের জন্মদিনের উপহার স্বরূপ তৈরি করার জন্যে অনুপম জুয়েলার্সে দিয়েছিলেন। পুলিশ সাথে সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও মূল্যবান হারটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
 প্রতিবেদনটা পরে চঞ্চল হয়ে ওঠলো তরুণ গোয়েন্দা সজীব। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে ওঠলো। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো সজীব। প্রবেশ করলো তার অন্যতম বন্ধু ও তার সহকারী অমর।
অমর সজীবের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে, কি ব্যাপার আজ তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
সজীব বললো, ‘আজকের সংবাদপত্র পড়েছিস?’
কৌতুহলী কণ্ঠে অমর বললো, ‘পড়িনিতো, কেন কি ব্যাপার?’
সংবাদপত্র অমরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সজীব বললো, ‘পড়ে দেখ!’
অমর পড়তে লাগলো। পড়া শেষ হলে বিষ্ময় কণ্ঠে বললো, ‘আশ্চর্য তো! জেলা প্রশাসক সাহেবের মেয়ের হার চুরি….!’
অমর প্রশ্ন করলো, ‘এখন কি করবি ঠিক করেছিস?’
সজীব কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, ‘হাতে তো তেমন কাজ নেই। সরকারীভাবে আহবান না পাওয়া পর্যন্ত নিজ থেকেই তদন্ত  চালিয়ে যাবো। চল, অনুপম জুয়েলার্সের মালিক জিম রহমান  সাহেবের সাথে আলাপ করে আসি।’
সম্মতি জানালো অমর, ‘চল।’
 ব্যক্তিগত মাইক্রো বাস নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো দু’জনে। নিউ মার্কেট এসে অনুপম জুয়েলার্সের দিকে এগিয়ে গেলো ওরা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মডার্ণ দোকান। গেটের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তরুণ গোয়েন্দা সজীবকে দেখে পুলিশ দ্বার ছেড়ে দাঁড়ায়। ওরা দু’জন ভেতরে প্রবেশ করে দোকানটির চারপাশ ভালো করে দেখে নিলো। আতর্কিত হামলায় শোচনীয় অবস্থা দোকানটার।
 সজীবকে দেখে এগিয়ে এলেন অনুপম জুয়েলার্সের মালিক জিম রহমান। প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি?’
‘আমি সজীব, গোয়েন্দা। সখ করে কিছু কিছু গোয়েন্দাগিরি করে থাকি। আর এ আমার বন্ধু ও সহকারী অমর।’
জিম রহমান খুশী হয়ে বললেন, ‘বেশ, বেশ; আপনার আগমনে আনন্দিত হয়েছি। তা হঠাৎ কি মনে করে?’
‘গত রাতের ঘটনাটির সম্বন্ধে কিছু জানতে এসেছি। যদি কিছু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন তবে কৃতার্থ হই। আশা করছি যথাসাধ্য আমাদের সহযোগিতা করবেন।’
‘বেশ যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।’
‘আপনি কতদিন আগে ডি.সি সাহেবের কাছ থেকে স্বর্ণ ও চুনী পাথরের হারটি তৈরি করার অর্ডার পেয়েছিলেন?’
‘পাঁচ দিন আগে।’
‘ডেলিভারি দিন ধার্য হয়েছিলো কবে?’
‘ডেলিভারি দিন ধার্য হয়নি। পনেরো দিন পরে ডি.সি সাহেবের মেয়ে তুলি’র জন্মদিন। তার আগেই হারটি ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিলো।’
   একটুক্ষণ থেমে জিম রহমান আবার বলতে লাগলেন, ‘ঘটনার  দিন রাত প্রায় আট টার সময় তুলি এসে বললো, হারটা দেখতে চায়। এরপর আয়রন সেফটা খুলে হারটা তাকে দেখালাম। হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ নেড়ে চেড়ে দেখে জানালো, ডিজাইনটা পছন্দ হয়নি। এরপর অন্য এক ডিজাইন দিয়ে গেলো।’
‘তুলি কে এর পূর্বে কখনও দেখেছিলেন কি?’
‘না।’
‘তুলি আপনার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার কতক্ষণ পর দোকানে ডাকাত পড়ে?’
‘প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর।’
‘এ সময় কোনো ক্রেতা কি আপনার দোকানে ছিলো?’
‘হ্যাঁ। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শরীফ রহমান।’
‘তিনি কেন এসেছিলেন?’
‘কোথায় নাকি তাঁর নিমন্ত্রণ ছিলো। নিমন্ত্রণের উপহার স্বরূপ কম দামী একটা অলঙ্কার কেনার জন্যে।’
‘আচ্ছা, শরীফ রহমান কি তুলির  হারটা দেখেছিলেন?’
‘হ্যা, দেখে বেশ প্রশংসা করছিলেন। এমন সুন্দর আর মূল্যবান হার।’
‘যখন আপনার দোকানে ডাকাত  পরে, তখন কি শরীর রহমান দোকানেই ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, সেই সময় তিনি দোকানেই ছিলেন। পরে গন্ডগোলে কোথায়  যে গেলেন লক্ষ্য করিনি।’
‘এখন বর্তমানে দোকানে কেনা বেচা বন্ধ রেখেছেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ, পুলিশ অফিসার অজয় শেখের নির্দেশে দোকানে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়না। এছাড়া তদন্তের সুবিধার্থে  কোনো জিনিস নাড়া চাড়াও করিনা।’
অমর চারদিক ভালো করে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছিলো এবং কথাবার্তার প্রয়োজনীয় অংশ নোট করে নিচ্ছিলো।
 জিম রহমান বললেন, ‘দেখুন বাবা সজীব। এ ব্যাপারে যখন নিজে থেকেই উৎসাহ দেখাচ্ছেন, তখন আমারও ইচ্ছে অপহৃত হারটা আপনি উদ্ধার করে দিন। আপনার তদন্তের ওপর যতটা ভরসা রাখা যায় পুলিশের ওপর তার কিছুই আশা করতে পারিনে।’
সজীব বললো, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করবো।’
ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলো সজীব ও অমর। যাবার সময় গেটে মোতায়নকৃত একজন পুলিশকে সজীব বললো, ‘অনুগ্রহ করে অজয় শেখকে বললেন, আমরা এসেছিলাম।’
অনুপম জুয়েলার্স থেকে বেরিয়ে  ওরা রওয়ানা দিলো বাসভবনের দিকে।
তরুণ গোয়েন্দা সজীব। অনার্স পড়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাইভেট গোয়েন্দার কাজ করে সে। বাবা দূর্বৃত্তের হাতে প্রাণ হারান। মাও বেঁচে নেই। ছেলের ভবিষ্যতের জন্যে বাবা অনেক কিছু করে গেছেন। কয়েকটা বাড়ি, গাড়ি, ধন- সম্পদ অনেক কিছুই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। দাদা ছিলেন জমিদার বংশের লোক। সজীবের বাবা ছিলেন একজন স্বনামধন্য সিআইডি পুলিশ অফিসার। সজীব ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে অনেক অভিযানে গেছে। শত বিপদেও বাবা ছেলেকে কাছ ছাড়া করেননি। সেই থেকে সজীব অসীম সাহসী এবং বুদ্ধিও খুব তীক্ষ্ণ। এতো কম বয়সী এই ছেলের সাহস আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি রীতিমতো লক্ষ্যনীয়।
দুই
ড্রইং রুমে বসে আছে সজীব। সাথে অমর। কেসটার গুরুত্ব নিয়ে ওরা আলাপ আলোচনা করছে।
 অমর বললো, ‘ঘটনাটা সহজ মনে হচ্ছেনা।’
সজীব ধীর কণ্ঠে বললো, ‘আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শরীফ রহমান এবং তুলির সাথে আলাপ করা একান্ত প্রয়োজন।’
অমর বললো, ‘পুলিশ তদন্ত শুরু  করে দিয়েছে। পুলিশ অফিসার অজয় শেখ সম্ভাব্যস্থানে একবার করে হানা দিয়েও শুনেছি কোন সুফল হয়নি।’
একটু থেমে আবার বললো, ‘ভাবছি এখন পর্যন্ত তোকে তাঁরা আহবান করছেন না কেন?’
সজীব মৃদু স্বরে বললো, ‘ভুলে যাচ্ছিস কেন যে, ওরা পুলিশ। ওরা সহজে তৃতীয় ব্যক্তিকে আহবান করতে চায়না। তাতে পুলিশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়। ইনচার্জ অফিসার যখন হাল ছেড়ে বসবার যোগার করেন, কেবল তখনই ওপর ওয়ালাদের আদেশে আমাদের মতো বেসরকারি গোয়েন্দাদের হাতে কেস তুলে দিতে বাধ্য হোন।’
  সহসা টেলিফোনটা বেজে ওঠলো। সজীব রিসিভার তুলে কৌতুহলী কণ্ঠে বললো, ‘হ্যালো, সজীব বলছি।…. আমাকে প্রয়োজন?…. আচ্ছা, আচ্ছা আমি আসছি। আচ্ছা এক্ষুনি…..  অনুগ্রহ করে দশ মিনিট অপেক্ষা করুন।
অমর প্রশ্ন করলো, ‘কে ফোন দিয়েছিলেন?’
‘তুলি।’
‘ডি.সি সাহেবের মেয়ে তুলি? এ যে দেখছি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির  উদয়!’
‘হ্যাঁ, চল জলদি।’
‘চল।’
গাড়ি নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো ডিসি সাহেবের বাসভবনের উদ্দেশ্যে।
এক সময় গাড়ি ডিসি সাহেবের বাঙলোর সামনে এসে থামলে একজন দারোয়ান ছুটে এলো। সজীব পরিচয় দিয়ে পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে দারোয়ানের হাতে দিয়ে বললো, আমাদের ডিসি সাহেবের মেয়ে তলব করেছেন। আমাদের তার কাছে নিয়ে চলুন।’
‘একটু অপেক্ষা করুন।’ বলে দারোয়ান ভেতরে প্রস্থান করলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললো, ‘আপনারা ভেতরে আসুন, দিদি মনি ডাকছেন।’
অন্দরমহলে প্রবেশ করতেই ওদের স্বাগত জানায় তুলি। বসতে বলে তাদের। সজীব ও অমর সোফায় হেলান দিয়ে বসে।
সজীব লক্ষ্য করে তুলিকে। বয়সে প্রায় সমবয়সী বলা যায়। চেহারা বেশ মাধুর্যপূর্ণ। দেখেই অনুমান করা যায় বেশ বুদ্ধিমতী।
 সজীব বললো, ‘এবার বলুন, ডেকেছেন কেন?’ এমন সময় বাসার কাজের লোক নানান রকম মিষ্টি ও ফল নাস্তা নিয়ে এলো।
তুলি বললো, ‘আগে এগুলো খেয়ে নিন। তারপর বলা যাবে।’
সজীব ও অমর নির্দ্বিধায় খেতে শুরু করলো। খাওয়া শেষ হলে তুলি মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘আপনি হয়তো অবগত আছেন, অনুপম জুয়েলার্স থেকে আমার স্বর্ণে চুনী পাথর বসানো মূল্যবান হারটা অপহৃত হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, পত্রিকায় দেখেছি নিউজটা।’
‘কেন জানিনে, আমার মন বলছে আপনিই আমার হারটা উদ্ধার করতে পারেন। পূর্বে কত জটিল কেসে আপনি তদন্ত চালিয়ে সফল হয়েছেন। অনেক পত্র পত্রিকায় পড়েছি আপনার সম্বন্ধে। আমার একান্ত ইচ্ছে এই কেসটা আপনি হাতে নিন।’
‘আপনি অনুরোধ না করলেও কেসটা হাতে নিতাম। কারণ, ইচ্ছে করেই হোক বা অনিচ্ছায় হোক কেসটার সাথে জড়িয়ে গেছি।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তুলি বললো, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
সজীব বললো, ‘অনুগ্রহ করে কিছু তথ্য দিয়ে আমায় সহযোগিতা করবেন।’
‘বেশতো আপনার যা জানার আছে জেনে নিন।’
‘স্বর্ণ ও মূল্যবান চুনী পাথর কতদিন আগে, কোথা থেকে আমদানি করা হয়েছিলো?’
‘ডাকাতি হওয়ার দিন দশের আগে সৌদি থেকে আমার এক আঙ্কেল পাঠিয়েছিলেন। উনি সৌদিতেই বসবাস করেন।’
‘যেদিন হারটা চুরি হয়, সেদিন অনুপম জুয়েলার্সে কেন গিয়েছিলেন?’
‘আমি? কই! আমিতো অনুপম জুয়েলার্সে যাইনি!’
‘অনুপম জুয়েলার্সের মালিক জিম রহমান যে বললেন, আপনি গিয়ে নতুন ডিজাইন দিয়ে এসেছিলেন। আগের ডিজাইন নাকি আপনার পছন্দ হয়নি?’
‘উনি ভুল করছেন। কোনদিনই আমি অনুপম জুয়েলার্সে যাইনি। প্রয়োজনে বাবা যান।’
‘আপনার সাথে জিম রহমানের কখনও আলাপ হয়নি?’
‘তাঁকে তো কোনওদিন দেখিইনি। আলাপ হবে কখন!’
সজীবের বুঝে গেলো যে, জিম রহমান প্রতারিত হয়েছেন হয়তো। তুলির ছদ্মবেশে হয়তো অন্য কেউ এসেছিলো জিম রহমানের দোকানে।
 সজীব ওঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা, আজ আমরা আসি। প্রয়োজনবোধে খবর পাঠাবেন।’
তিন
তুলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলো ওরা দু’জন।
সজীব বললো, ‘চল অমর, এবার আমরা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শরীফ রহমানের সাথে একটু আলাপ করে আসি।’
একবাক্যে সায় দিলো অমর, ‘চল।’
 এক সময় গাড়ি শরীফ রহমানের প্রতিষ্ঠানের কাছে এসে থামলো। সজীব ও অমর মাইক্রো বাস থেকে নেমে এগিয়ে গেলো। গেটে মোতায়েনকৃত সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রতিষ্ঠানের মালিক, শরীফ রহমান সাহেব আছেন?’
‘হ্যাঁ, আছেন। উনার নিজস্ব অফিস রুমে, ওপর তলায়।’
শরীফ রহমানের অফিস কক্ষের সামনে এসে দেখলো চেয়ারে একজন বৃদ্ধ লোক বসে রয়েছেন।  সজীবকে দেখে ওঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কাকে চায়?’
‘শরীফ সাহেব কে।’
‘কিন্তু তিনিতো কারো সাথে দেখা  করবেননা। আমার ওপর নির্দেশ আছে, সাহেবের বিনা অনুমতিতে কাউকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া যাবেনা।’
সজীব পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললো, ‘কিন্তু তিনি আমাদের সাথে দেখা করবেন। এই কার্ডটি তাকে দেখিয়ে বলুন, আমি তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছি।’
 লোকটি ভেতরে প্রবেশ করলো। একটুক্ষণ পর ফিরে এসে বললো, ‘আপনারা ভেতরে যান, সাহেব ডাকছেন।’
সজীব ভেতরে প্রবেশ করে, তাকে অনুসরণ করে অমর।
শরীফ রহমান আহবান জানান, ‘আসুন ইয়াং ম্যান। তারপর কি মনে করে?’
সজীব ধীর কণ্ঠে বললো, ‘যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করবো।’
‘বেশ তো। বলুন?’
‘যেদিন ডিসি সাহেবের মেয়ের মূল্যবান হারটা চুরি হয়, সেদিন আপনি অনুপম জুয়েলার্সে কেন গিয়েছিলেন বলবেন কি প্লিজ?’
‘একটা বিয়ের দাওয়াত ছিলো। প্রেজেন্টেশন স্বরূপ একটা অলঙ্কার কেনার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম।’
‘আপনি যখন অনুপম জুয়েলার্সে গিয়েছিলেন, তখন কোনও মেয়েকে কি সেখানে দেখেছিলেন?’
‘কই না তো। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?’
সজীব কথার মোড় ঘুরিয়ে বললো, ‘না, এমনিতেই। আচ্ছা, আপনি হারটা দেখেছিলেন কি?’
‘দেখেছিলাম। বেশ চমৎকার আর মূল্যবান হার।’
‘যখন ডাকাতদল দোকানে হামলা চালায়, তখন আপনি দোকানেই ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, সেই সময় আমি দোকানেই ছিলাম। ডাকাত দলের আতর্কিত হামলায় প্রথমে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরে সুযোগ বুঝে প্রাণটা হাতে নিয়ে কোনও রকম পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।’
‘আচ্ছা, আপনার এই প্রতিষ্ঠান কত দিনের?’
‘প্রায় পাঁচ বছর।’
‘কখন থেকে জিম রহমানের সাথে আপনার পরিচয়?’
‘এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই উনার সাথে আমার পরিচয়।’
‘আচ্ছা, জিম রহমানের সাথে আপনার পরিচয়ের পর থেকে এই পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁর দোকানে এই রকম ঘটনা ঘটতে দেখেছেন কি?’
‘না তো।’
সজীব বললো, ‘দেখুন, কেসটার সাথে আমি জড়িয়ে পড়েছি। মাঝে মধ্যে যদি এখানে আপনার কাছে আসতে হয়, তবে দয়া করে কিছু মনে করবেন না যেন।’
শরীফ রহমান একগাল হেসে বললেন, ‘না- না, মনে করার কি আছে। মাঝে মাঝে আসবেন, আমি বরং খুশীই হবো।’
ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলো সজীব ও অমর।
চার
   টেলিফোন কলের একটানা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো সজীবের। বিরক্তবোধ করে সজীব। বিছানা ছেড়ে ওঠে রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললো, ‘হ্যালো, সজীব বলছি…. কি বললেন! সলিল মিয়া.. খুন হয়েছেন! শান্তি ভিলা…? হ্যা, হ্যা অপেক্ষা করুন, এক্ষুনি আসছি।’
রিসিভার রেখে দিলো সজীব।
মনে মনে ভাবলো, অমরকে খবর দিলে দেরি হয়ে যাবে। গাড়ি নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়লো সে। এক সময় শান্তি ভিলার সামনে গাড়ি এসে থামে। গাড়ির শব্দ পেয়ে একজন মেয়ে, বয়স আনুমানিক সতেরো আঠারো হবে ; দরজা খুলে কান্না  ভেজা মলিন কণ্ঠে বললো, ‘আসুন, আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।’
সজীব ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো, আগে মৃত দেহের কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।’
 মেয়েটির বাবা সলিল মিয়ার ঘর এটি। সজীব দেখলো, ভয়ংকর এক দৃশ্য। সমস্ত মেঝে ছোপ ছোপ রক্তে ভরে গেছে। সলিল মিয়ার বুকে বেশ কয়েক জায়গায় ছোরা বিদ্ধ হয়েছে! এমন রোমহষর্ক দৃশ্য দেখে আর সহ্য করতে পারলোনা মেয়েটি। ‘বাবা..’ বলে আর্তনাদ করে কেঁদে ফেললো।
  সজীব চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলো। ঘরের গরাদহীন জানালাটা খোলা। ঐদিন দিয়েই বোধহয় হত্যাকারী ঘরে প্রবেশ করেছিলো। জানালাটার কাছে গিয়ে দেখলো; না তেমন কোনও চিহ্ন বা আলামত নেই।
 সজীব বললো, ‘যা দেখার দেখলাম। এবার চলুন।’
 ওরা ড্রইংরুমের দিকে গেলো। সজীব মেয়েটিকে শান্তনা দিয়ে বললো, ‘আপনি ভেঙে পড়লে চলবেনা। যা হবার তা তো হয়ে গেছে। মনটাকে শক্ত করুন। ভেঙে পড়বেননা প্লিজ।’
 একটুক্ষণ নিরব থেকে সজীব আবার বললো, ‘আচ্ছা, পুলিশকে খবরটা জানিয়েছেন?’
চোখের জল মুছতে মুছতে মেয়েটি বললো, ‘না। জানি পুলিশে খবর দিয়ে লাভ হবেনা। আজকাল অনেক খুন খারাপির ঘটনা ঘটে। পুলিশ বা সরকারি ভাবে একটা ঘটনার সুরাহা হলে একশোটা ঘটনার কোনও সুরাহা হয়না। কোথাও কোথাও দু’একটা ভালো পুলিশ থাকলেও  নিরানব্বইজন পুলিশই ধান্দাবাজ। তাই আগে আপনাকে প্রথম খবরটা দিয়েছি।’
‘বেশ। আচ্ছা বলুনতো, কে আগে সলিল মিয়ার মৃতদেহ দেখতে পায়?’
‘আমিই আগে বাবার মৃতদেহ দেখি। পাশের ঘরে থাকি আমি। হঠাৎ বিকট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ বাবার প্রাণফাটা চিৎকার শুনতে পাই। সাথে সাথে বাবার ঘরে ছুটে গিয়ে দেখি, বাবা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। কে বা কারা বাবাকে খুন করে পালিয়েছে।’
‘বাড়িতে আপনারা কে কে থাকেন?’
‘মা বেঁচে নেই। আমি আর বাড়ির  একটা কাজের মেয়ে মোমেনা। এছাড়া কেউ নেই।’
‘আপনার বাবা কি করতেন?’
‘বাবা ব্যবসা করতেন। বাবার দোকানের নাম প্রত্যাশা স্টোর্স।’
‘আচ্ছা, সলিল মিয়ার অবর্তমানে আপনিই তো হবেন প্রত্যাশা স্টোর্স এবং এই বাড়ি বা সম্পত্তির মালিক?’
‘জ্বি।’
‘গতকাল সলিল সাহেব দোকান থেকে কখন ফিরেছিলেন?’
‘রাত দশটার দিকে।’
‘প্রতিদিনই তিনি কি প্রায় একই সময় ফিরতেন?’
‘হ্যা।’
‘গতরাতে তিনি যখন বাড়ি আসেন তখন তাকে কোনও রকম অস্বাভাবিক  অবস্থায় দেখেছিলেন কি?’
‘না তো।’
‘আপনার বাবা খুন হয়েছেন কিন্তু আপনাদের কোনও জিনিস  চুরি হয়েছে কি?’
‘বিশেষ কিছুই চুরি হয়নি। তবে একটা চকচকে মার্বেল পাথরের মূর্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা! বাবার ঘরের আলমারীতেই ছিলো।’
সজীব কিছুটা আশ্চর্য হলো! একটা মার্বেল পাথরের মূর্তি! কেমন একটা রহস্য মনে হচ্ছে ব্যাপারটা!
সজীব ধীর কণ্ঠে বললো, ‘একজন কাজের মেয়ের কথা বললেন যে। তাকে একটু ডাকুন।’
 মেয়েটি মোমেনাকে ডেকে নিয়ে এলো। মধ্যবয়স্কা। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, একেবারে ঘাবড়ে গেছে। খুন টুনের ব্যাপার কখনও দেখেনি হয়তো।
সজীব প্রশ্ন করে, ‘আপনিই মোমেনা?’
‘হ্যা, সাব।’
‘কতদিন ধরে এখানে আছেন?’
‘প্রায় দশ বছর।’
‘গতরাতে কোনো গোলমালের শব্দ পেয়েছিলেন?’
‘না, সাব।’
‘ঠিক আছে আপনি যান। ঘাবড়ানোর কোনও কারণ নেই।’
সজীব মেয়েটিকে বললো, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। এখন আমি যাচ্ছি। আপনি পুলিশে ফোন করে জানান। ওরা এসে মৃতদেহ নিয়ে যাক। আমি প্রয়োজন হলে আগামীকাল আবার আসবো।’
সজীব বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
পাঁচ
 সহসা টেলিফোনে বেজে ওঠে। সজীব রিসিভার তুলে কথা বলে সজীব। ফোন করেছেন কমিশনার কে.এম.খান, পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সজীব পুলিশ  হেড কোয়ার্টারে উপস্থিত হয়। সাথে অমর। 
 
পুলিশ কমিশনার তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেন, ‘ধন্যবাদ, এসো।’
 
পুলিশ হেড কোয়ার্টারে জরুরি গোপন সভা বসেছিলো। 
গম্ভীর কণ্ঠে কমিশনার বললেন, ‘বড় সমস্যায় পড়ে তোমাকে ডেকেছি।’
 
‘বলুন স্যার, কিভাবে সাহায্য করতে পারি।’
 
‘বসো বলছি।’
 
সজীব ও অমর আসন গ্রহণ করে বসলো। পুলিশ অফিসার অজয় শেখকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সজীব জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার স্যার, এমনভাবে চুপচাপ বসে আছেন? বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে আপনাকে!’
 
পুলিশ অফিসার গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘দেখছোনা ভাই, শহরের আসামিরা আমাদের এতোটুকুও শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেনা। আজ এখানে ডাকাতি, কাল ওখানে খুন এসব লেগেই আছে!’
 
কমিশনার বললেন, ‘শোনো সজীব, আমাদের অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা তোমার কাছে ঋণী। আজ আমার একটি অনুরোধ, আমাদের সম্মান রক্ষা করো। তুমি হয়তো জেনেছো, সলিল মিয়া কোন অজ্ঞাত হত্যাকারীর হাতে খুন হয়েছেন। পুলিশ অফিসার অজয় শেখ চুরি যাওয়া হারটা উদ্ধারে ব্যস্ত আছেন। তাই তোমার প্রতি আমার অনুরোধ, তদন্ত করে সলিল মিয়ার হত্যাকারীকে এ্যারেষ্ট করে দাও।
 
সজীব বললো, ‘এই কেসটা আমি হাতে নিয়েছি। সলিল সাহেবের মেয়ে আমায় ডেকে কেসটা আমাকে দিয়েছেন।’
 
কমিশনার কে.এম.খান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘যাক, অনেকটা হালকা আর চিন্তা মুক্ত  হলাম। তোমার যখন যা দরকার বলবে, অজয় শেখ তোমাকে সব ধরনের সাহায্য করবেন।’
 
সজীব পুলিশ অফিসার অজয় শেখকে বললো, ‘সলিল মিয়ার ময়না তদন্তের রিপোর্টটা জানতে  চাই।’
 
অজয় শেখ একটি ফাইল এনে সজীবের হাতে দিলেন। সজীব ভালোভাবে ফাইলটাতে চোখ বুলাতে লাগলো এবং প্রয়োজনীয় অংশ নোটবুকে টুকে নিয়ে ফাইলটি ফেরত দিলো। এবার বিদায় নেয়ার জন্যে ওঠে দাঁড়ালো সজীব। বললো, ‘আমরা এখন আসি। আশা করি এই কেসটাতেও আমি সফল হবো।’
 
কমিশনার কে.এম.খান বললেন,  ‘তোমার কৃতকার্যতা একান্তভাবে কামনা করি।’
 
পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে গাড়িতে এসে ওঠলো সজীব ও অমর। হঠাৎ করে একটা চিঠি গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতরে এসে পড়লো। অমর গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখলো। কোথাও কেউ নজরে পড়লোনা। গাড়িতে ওঠে আসে অমর। সজীব চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে লাগলো। চিঠিতে লেখা রয়েছে –
সজীব, 
সজীব মিয়া হত্যার ব্যাপারে তুমি বাড়াবাড়ি করোনা। একদম না। ও কাজে তোমার মৃত্যুই ডেকে আনবে। আমি তোমার শুভাকাঙ্খী। আমি চাইনে, এই কেসটা হাতে নিয়ে তুমি অকালে প্রাণটা হারাও। সাবধান। 
ইতি – তোমার শুভাকাঙ্খী। 
 
সজীব চিঠিটা পড়ে অমরের হাতে দিলো। অমর সেটি পড়ে বিস্মিত হলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, তা হলে দেখছি কোনো ব্যাটা আমাদের অনুসরণ করছে!’
 
সজীব বললো, হুম। কেউ আমাদের ওপর সব সময় নজর রাখছে মনে হচ্ছে!’
 
সজীব গাড়িতে ষ্ট্যাট দেয়, গাড়ি চলতে থাকে। মৃদু কণ্ঠে সজীব বললো, ‘অপরাধী ভেবেছে ওদের হুমকিতে এ কেসটা ছেড়ে দেবো! না, কিছুতেই না। এখন থেকে আমাদের সতর্ক হয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।’
 
অমর বললো, ‘চল আমরা একটু প্রত্যাশা ষ্টোর্স থেকে ঘুরে আসি।’
 
‘হুম, চল।’ সম্মতি জানালো সজীব। 
 
এক সময় ওরা প্রত্যাশা ষ্টোর্স এসে পৌঁছে। শহরের খ্যাতনামা দোকানগুলোর একটি হচ্ছে প্রত্যাশা ষ্টোর্স। মানুষের দৈনন্দিন  জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র প্রায় সবই পাওয়া যায় এখানে। প্রত্যাশা ষ্টোর্স হচ্ছে  একটি মেগা শপিং মল। দোকানের মালিক সলিল মিয়ার মিয়ার মৃত্যুতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। দোকানের কর্মচারীরা একটা অজানা ভয়ে ভীত থাকে। দোকান থেকে পালাতে পারলেই যেনো বেঁচে যায়। কিন্তু পুলিশ হুকুম জারি করে রেখেছে, সলিল মিয়ার হত্যাকারী এ্যারেষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কেউ কোথাও যেতে পারবেনা। এদিকে সলিল মিয়া খুন হওয়ার পর থেকে তাঁর মেগা শপিং মলে আর কেনা বেচাও হয়না। 
 প্রতিষ্ঠানের একজন অর্ধ বয়ষ্ক কর্মচারীকে সজীব বললো, ‘একটু বিশেষ দরকারে আমরা এখানে এসেছি। সলিল সাহেব হত্যার কেসটা আমি হাতে নিয়েছি।’
 
‘ও আচ্ছা। আপনিই সজীব?’
 
‘জ্বি হ্যা।’
 
‘ভালো লাগলো আপনার সাথে পরিচয় হয়ে। আমার নাম আব্বাস।’
 
‘ধন্যবাদ। আমার কয়েকটি কথা জানার আছে। আশা করছি যথাসাধ্য জানাবেন।’
 
‘বেশ, বলুন?’
 
‘এই প্রতিষ্ঠানে আপনি কতদিন ধরে কাজ করছেন?’
 
‘প্রায় সাত বছর।’
 
‘আচ্ছা, সলিল সাহেবকে আপনার কেমন মানুষ বলে মনে হতো বলবেন কি প্লিজ?’
 
‘মানুষটা মন্দ ছিলেন না। তবে একটু রগচটা ছিলেন। অবশ্য বয়স হলে মানুষ একটু রগচটা হয়ে যান সাধারণত।’
 
‘তা ঠিক, সলিল সাহেবেরও বেশ বয়স হয়েছিলো। যাকগে। আচ্ছা, বলতে পারেন কি – সলিল সাহেব যে মার্বেল পাথরের চকচকে একটি মূর্তি বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মূর্তিটি কোথা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো?’
 
‘তবে শুনুন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শরীফ রহমানের সাথে আমাদের  বাবু সলিল মিয়ার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। একদিন শরীফ সাহেব এবং সলিল সাহেব গিফট কর্ণার থেকে ঘর সাজানোর জন্যে দু’জনে দু’টো মার্বেল পাথরের চকচকে সুন্দর মূর্তি কিনে শরীফ সাহেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে দু’জনে গল্প গুজব করতে থাকেন। তারপর এক সময় সলিল সাহেব  শরীফ সাহেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তাঁর মূর্তিটি ভুলে রেখে চলে আসেন। মূর্তিটি কিছুদিন শরীফ সাহেবের কাছে থাকারপর গত পরশু দিন সলিল সাহেব শরীফ সাহেবের বাসা থেকে বাসার জনৈক কাজের লোকের কাছ থেকে নিয়ে আসেন।’
 
‘বাসা থেকে মূর্তিটা নিয়ে আসার অনুমতি কি শরীফ সাহেব দিয়েছিলেন?’
 
‘শুনেছি, শরীফ সাহেব সে সময় ছিলেন না, ব্যবসার কাজে বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন। আর মূর্তি তো সলিল সাহেবের। তাছাড়া দু’জনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এখানে অনুমতির ব্যাপারটা মূখ্য নয়।’
 
সজীব বললো, ‘ধন্যবাদ। এবার আমরা আসি। প্রয়োজন মনে করলে আবারও আসতে পারি।’
 
বিদায় নিয়ে গাড়িতে ওঠে বসলো ওরা। সজীব গাড়ি ড্রাইভ  করছে। পথ চলতে চলতে সজীব বললো, ‘আমার মনে হয় সেই মূর্তিটির মধ্যেই কোনও রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।’
 
অমর শান্ত স্বরে বললো, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’
 
এক সময় গাড়ি সজীবের বাস ভবনের সামনে এসে থামলো। 
 
ছয়
সজীব তার ড্রইং রুমে বসে রয়েছে। নানা রকম চিন্তা ভাবনা এসে, ওর মাথায় জট পাকাচ্ছে। এমন সময় অমর এসে বললো, ‘তুলি খবর পাঠিয়েছে। তোকে যেতে হবে ; চল।’
  সজীব তৈরি হয়ে নেয়। গারেজ ঘর থেকে গাড়ি বের করে রওয়ানা দেয় দু’জনে। কিছুক্ষণ পর ওরা ডি.সি সাহেবের বাঙলোর সামনে এসে পৌঁছে। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায় সজীব ও অমর। গাড়ির শব্দ পেয়ে তুলি সদর দরজার কাছে এসে বললো, ‘আসুন।’
তুলি ওদের ভেতরে নিয়ে যায়। গেস্ট রুমে এসে বসলো তিন জনে।
সজীব বলে, ‘এবার বলুন, হঠাৎ তলব করার কারণ?’
‘হারটা উদ্ধারের কাজ কতদূর এগিয়েছে?’
‘তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, আপনার জন্মদিনের আগেই আপনার হারটা উদ্ধার করে দিতে পারবো।’
‘কেসটা আপনার হাতেই দিয়েছি। আমার বিশ্বাস আপনি সফল হবেন।’
এমন সময় কাজের লোক চা নাস্তা দিয়ে গেলো।
তুলি বললো, ‘নিন, শুরু করুন।’
দু’জনকে দু’টো প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা প্লেট নিলো তুলি।
খাওয়া শেষ হলে সজীব জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার জন্মদিন আর কয়দিন বাকী?’
‘আর মাত্র তিন দিন।’
‘ঠিক আছে। চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিরাশ হওয়ার কিছু নেই।’
সজীব যাওয়ার জন্যে ওঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘যদি কিছু মনে না করেন তবে এখন আমরা বিদায় নিই?’
তুলি হাসি মুখে বললো, ‘আপনাদের মতো স্বনামধন্য গোয়েন্দাদের কি আমি বেশিক্ষণ  আটকিয়ে রাখতে পারবো? তবে মাঝে মধ্যে বোন মনে করে হোক বা বন্ধু হোক মনে করেই হোক আসবেন কিন্তু।’
সজীব আনন্দিত হয়ে বললো, ‘বোন বা বন্ধুই যখন হলেন তখন “আপনি” করে বলার কি দরকার । বোন বা বন্ধু কি কখনও আপনি করে বলে?’
তুলি বললো, ‘যাক ভাই, আমি খুশি হলাম। ভাই বা বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিতও বটে।’
অমর বললো, ‘দেখ বন্ধু, বোন বন্ধু পেয়ে আমাকে আবার ভুলে যাসনা যেনো!’
ওর কথা শুনে হেসে ওঠলো সবাই।
 সজীব ও অমর তুলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর ডি.সি সাহেব এলেন। সাথে পুলিশ অফিসার অজয় শেখ।
দু’জনে গেস্ট রুমে গিয়ে বসলেন।
ডি.সি সাহেব অজয় শেখকে বললেন, ‘আমার মেয়ের জন্মদিনের আর মাত্র তিন দিন বাকি আছে। তার আগে যদি হারটা উপহার না দিতে পারি আর জন্মদিনের পরে যদিও উদ্ধার করে দেন তবে আর কি হবে! আসল আনন্দটাই তো আর থাকবেনা।’
‘আশা করি জন্মদিনের আগেই হারটি উদ্ধার করতে সক্ষম হবো স্যার।’
‘তা যায় বলুন না কেন, আপনাদের ওপর আমার মেয়ে তুলি’র ভরসা বা বিশ্বাস নেই। সেই জন্যে তুলি নিজ থেকেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ সজীবকে ডেকে কেসটা তার হাতে দিয়েছে।’
অজয় শেখ কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, ‘সজীবের হাতে! কই এ কথাতো সজীবের কাছ থেকে শুনিনি!’
ডি.সি সাহেব কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘সেই তরুণ গোয়েন্দা আপনাদের মতো তো আর ঢোল পিটিয়ে বেড়ায় না।’
অজয় অবশ্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ সজীব যখন কেসটা হাতে নিয়েছে তখন কিছুটা চিন্তামুক্ত হলাম স্যার।’
ডি.সি সাহেব বললেন, ‘সজীবের ওপর দেখছি আপনারও বিশ্বাস রয়েছে।’
অজয় শেখ বললেন, ‘আগে বহুবার আমাদের সাহায্য করেছে সে।’
অজয় শেখ যাওয়ার জন্যে ওঠে দাঁড়ালেন।
মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘এবার আমি আসি, স্যার।’
ডি.সি সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, আসুন তা হলে।’
 পুলিশ অফিসার অজয় শেখ বিদায় নিয়ে চলে যেতেই তুলি গেস্ট রুমে প্রবেশ করে ডি.সি সাহেব কে বললো, ‘পুলিশ অফিসার  অজয় আংকেল কি বললেন বাবা?’
‘বললেন, যথাসাধ্য তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন।’
‘তা যায়ই বলোনা কেন বাবা, পুলিশ আংকেল যে সফল হবেন এই আশা অত্যান্ত ক্ষীণ। এই দেশের পুলিশ কাজেরই না। অবশ্য দু’একজন যে ব্যতিক্রম নয় তা নয়। কিন্তু অধিকাংশই নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্থ, অনৈতিক কাজে জড়িত। এরা শুধুই সরকারের অন্য ধ্বংস করে। আর ঘুষ খেতে পটু। পুলিশ জনতার জান মালের নিরাপত্তা সেবার জন্যেই রয়েছে। কিন্তু কয়জন পুলিশ সাধারণ মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠতে পেরেছে! আজকালতো হীন স্বার্থে নিরপরাধ মানুষকেও ইয়াবা বা মাদব দিয়ে ফাঁসিয়েছে ওরা! পত্র পত্রিকায় তাদের কত যে অপরাধের দলিল রয়েছে তার হিসেব নেই! কয়টার সুরাহা হয়েছে? সম্প্রতি সিনহা হত্যার পেছনেও পুলিশের  হাত রয়েছে এটা সবাই বুঝে গেছে। সাগর – রুনি হত্যার কোনও সুরাহা হলোনা! তনু, নুসরত, রিফাত, বিশ্বজিত,
তানিয়া,রিয়াদ,খাদিজা এছাড়াও  আরও কত শত কেসের নেপথ্য কাহিনি, ন্যায় বিচার আজও হলোনা!’
‘তারপরও ভালো কিছু লোক পুলিশ, প্রশাসনে রয়েছে এটা কি তুমি অস্বীকার করো মা?’
‘না অস্বীকার করিনা। কিন্তু সংখ্যায় অত্যান্ত নগন্য। আর শত সহস্র দুর্নীতিগ্রস্থ, ঘুষখোর, ধান্দাবাজদের ভীড়ে ভালো, সৎদের সংখ্যা এতোই নগণ্য যে সাধারণত মানুষ পুলিশের কাছে সহজে যেতে চায়না! তাদের বন্ধু মানতে চায়না।’
ডি.সি সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়েও আর বললেননা।
তুলি আবারও বলতে লাগলো, ‘আমি পুলিশের চেয়ে সজীবকেই বেশি বিশ্বাস করি বাবা। আমার বিশ্বাস সজীব সফল হবে। তুমি আসার কিছুক্ষণ আগে সজীবকে ডেকেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কাজের কতদূর? উত্তরে বললো, এগিয়ে যাচ্ছি, হতাশার কিছু নেই। আমার বিশ্বাস সে সফল হবে।’
‘তা হলে আমি খুব আনন্দিত হবো।’
ডি.সি সাহেব গেস্ট রুমে থেকে বেরিয়ে তাঁর নিজস্ব রুমের দিকে গেলেন।
সাত
  মাইক্রো বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সজীব ও অমর। এক সময় ওরা শরীফ রহমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে এসে পৌঁছে। গাড়ি থেকে নেমে ওরা এগিয়ে গেলো শরীফ রহমানের অফিস কক্ষের দিকে।
ভেতরে প্রবেশ করতেই শরীফ রহমান অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘আসুন আপনারা। তারপর কি মনে করে?’
সজীব বললো, ‘তেমন কারণ নেই বলতে পারেন। এই পথ ধরে  যাচ্চিলাম, ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই।’
‘তা বসুন।’ বললেন শরীফ রহমান।
সজীব বললো, ‘আমাদের একটু অন্য কাজ আছে, বেশিক্ষণ বসতে পারছিনা আজ। আচ্ছা, আপনার বাড়ির ঠিকানাটা একটু লিখে দিবেন প্লিজ? রাতে এক সময় ফ্রি থাকলে আলাপ আলোচনা, গল্প আড্ডা করে আসতাম এই আরকী।’
শরীফ রহমান একটা প্যাডের পাতায় খস্ খস্ করে তাঁর বাড়ির ঠিকানা লিখে সজীবের হাতে দিলেন।
সজীব ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে ওঠে এলো। সাথে অমরও।
ঠিকানাটা দেখে বিস্মিত হয় সজীব! আশ্চর্য! সেই যে একদিন পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে গাড়িতে যে চিঠিটা পেয়েছিলো সে চিঠির হাতের লেখার সাথে শরীফ সাহেবের হাতের লেখার হুবহু মিল!
সজীব বললো, আমার মনে হচ্ছে, সলিল সাহেবের হত্যার সাথে শরীফ সাহেব জড়িত।’
অমর শরীফ সাহেবের হাতের লেখাটা দেখতে দেখতে বললো, ‘আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।’
কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবার অমর বললো, ‘শোন, শরীফ সাহেবের বাসায় গিয়ে সেই মার্বেল পাথরের মূর্তিটা কৌশলে খুঁজে বের করতে হবে। মনে হচ্ছে ওটাতেই একটা রহস্য লুকিয়ে আছে।’
সজীব ধীর কণ্ঠে বললো, ‘চল, এখন আমরা শরীফ সাহেবের বাসায় যাই। তিনি এখন বাসায় নেই, এই সুযোগ। বাসার কাজের  লোকদের কৌশলে পটিয়ে পাটিয়ে মূর্তিটি হাসিল করা যায় কি না দেখি গিয়ে।’
অমর সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘হুম, চল তাহলে।’
শরীফ সাহেবের বাস ভবন খুঁজে বের করতে বেশি বেগ পেতে হলোনা। বাসার কাছাকাছি একজন পথিককে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো। গাড়ি শরীফ সাহেবের বাস ভবনের গেটের সামনে এসে থামতেই একজন মধ্য বয়স্ক কাজের লোক বের হয়ে এসে বললো, ‘কাকে চান?’
সজীব কিছুটা গাম্ভীর্যের স্বরে বললো, ‘বিশেষ কাজে শরীফ সাহেব আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন।’
অমর চালাকি করে বললো, ‘শরীফ সাহেব আমার বাবার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’
লোকটি বললো, ‘তা বেশ। আপনাদের প্রয়োজনটা কি বলবেন?’
সজীব বললো, বাসায় নাকি শরীফ সাহেবের একটি মার্বেল পাথরের মূর্তি রয়েছে? মূর্তিটি শরীফ সাহেব চেয়ে পাঠিয়েছেন।’
লোকটি মনে মনে বললো, ‘মূর্তিটি না চেয়ে পাঠালে এরা মূর্তির কথা কি করে জানবে! একটা মূর্তিই তো। মহামূল্যবান কোনও জিনিসতো নয়।
লোকটি মৃদু হেসে বললো, ‘হ্যা, হ্যা। বাবুজির শোবার ঘরে আলমারিতেই মূর্তিটি রাখা আছে। সেটিতো আমাদের বাবুজি রোজই দেখেন। সামান্য একটা মূর্তির মাঝে যে তিনি কি পান তিনিই জানেন। আচ্ছা, আপনারা একটু দাঁড়ান আমি ওটা এনে দিচ্ছি।’
লোকটি ভেতরে প্রবেশ করে কি জানি কি মনে করে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সলিল সাহেবকে ফোন দিলো…।  না। তিনি ফোন ধরছেন না! আজকাল নিম্ন শ্রেণির কাজের লোকদের  ফোন বড় বাবুরা সহজে ধরতেই চাননা! যাকগে একটি মার্বেল পাথরের মূর্তিই তো। ভেতরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ পর মূর্তিটি হাতে নিয়ে ফিরে আসে। তারপর সজীবের হাতে দেয়।
সজীব ধন্যবাদ জানিয়ে বললো, ‘আমরা তবে আসি, চাচা।’
লোকটি মাথা নেড়ে বললো, ‘ঠিক আছে বাবুরা এসো।’
  বিদায় নিয়ে ওরা গাড়িতে ওঠে এলো। সজীব গাড়ি ড্রাইভ করছে। অমর মূর্তিটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই মূর্তির ভেতর থেকে কেমন একটা শব্দ হলো! অমর বুঝলো মূূর্তিটির ভেতরের অংশ ফাঁকা। নিচের দিকে দেখলো জোড়া লাগানোর দাগ! নিশ্চয় মূর্তির ভেতর কিছু ভরে রাখা হয়েছে। এরপর নিচের দিকটা আবার জোড়া দেয়া হয়েছে! সজীবের হাতে মূর্তিটা দিয়ে অমর বললো, ‘নিশ্চয় এর ভেতর কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে।’
সজীব একহাতে স্টিয়ারিং ধরে অপর হাতে মূর্তিটি নাড়াচাড়া করে দেখে বললো, ‘হুম। তাইতো মনে হচ্ছে!’
এক সময় ওরা বাসার সামনে এসে পৌঁছে। সজীব ও অমর গাড়ি থেকে নেম বাসার ভেতরে প্রবেশ করে।
বসার ঘরে এসে দু’জনে বসে পড়ে। সজীব মূর্তিটির একেবারে নিচের দিকে যেখানে জোড়া লাগানোর দাগ রয়েছে সেখানে হাতুড়ি দিয়ে ভাঙতে থাকে। নিচের কিছু অংশ ভেঙে যেতেই চমকে ওঠে সজীব! মূর্তির ভেতরে স্বর্ণে মূল্যবান চুনী পাথর বসানো একটি হার! অমরের হাতে মূর্তিটা দিয়ে সজীব বললো, ‘আমরা সত্যিই দারুণ চাল চেলেছি।’
অমর উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো, ‘এক ঢিলে দুই পাখি। প্রথমত, তুলি’র হার উদ্ধার ; দ্বিতীয়ত সলিল মিয়ার হত্যার আসামি গ্রেফতার।’
সজীব সেলফোনটা পকেট থেকে বের করে তুলির বাসার ল্যান্ড ফোনে কল করে। ফোন রিসিভ করলো তুলি। সজীব উচ্ছ্বাসের স্বরে বলে, ‘হ্যালো, তুলি?… ইমিডিয়েট আজ দুপুরে পার্টির আয়োজন করুন প্লিজ। পরিচিত সবাইকে নিমন্ত্রণ করুন।….. হ্যা, বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ ….  আমি পার্টিতে বিস্তারিত সব বলবো । এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।….. হ্যা, আমি আসছি।… আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
ফোন রেখে দেয় সজীব।
ক্রমশ দুপুর গড়িয়ে এলো। গন্তব্য স্থানে রওয়ানা দেয় সজীব । সাথে অমর।
এক সময় ওরা ডি.সি সাহেবের বাঙলোয় পার্টি রুমে এসে উপস্থিত হয়। নিমন্ত্রিত প্রায় সবাই উপস্থিত হয়েছেন। দুপুর দু’টো। শুরু হলো আপ্যায়নের পালা। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সজীব চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর পার্টি রুমের মঞ্চে ডেস্ক টেবিলের সামনে মাইক্রো ফোনে শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘সম্মানিত অতিথি বৃন্দ, আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি শ্রদ্ধেয় ডি.সি স্যারের মেয়ের হার এবং সলিল হত্যাকারীকে চিহ্নিত এবং গ্রেফতার করতে।’
একটু থেমে আবার বললো, ‘সম্মানিত সুধী মন্ডলী, আপনারা সকলেই অবগত আছেন, অনুপম জুয়েলার্স অর্থাৎ জিম রহমান সাহেবের দোকানে ডাকাত দল আতর্কিত হামলা চালিয়ে একটি চুনী পাথরের মূল্যবান স্বর্ণের হার লুণ্ঠন করে পালিয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ডাকাত দল হারটি লুণ্ঠন করতে পারেনি।’
ডি.সি সাহেব বললেন, ‘তাহলে?’
সজীব আগের মতোই শান্ত কণ্ঠে  বললো, ‘হারটি চুরি করেছেন ডাকাত দল যখন প্রবেশ করে তখন যিনি উপস্থিত ছিলেন।’
জিম রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘শরীফ রহমান!’
সজীব দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘হ্যা, শরীফ রহমানই চুরি করেছিলেন।’
শরীফ রহমান চিৎকার করে বললেন, ‘কাল্পনিক মন্তব্য কেন করছেন! প্রমাণ দিতে পারবেন?’
সজীব দৃঢ় স্বরে বলে, ‘বিনা প্রমাণে কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত  করা আমার কর্ম নয়।’
শরীফ রহমান গর্জে ওঠে বললেন, ‘একজন ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে মিথ্যে রটনার জন্যে আপনার বিরুদ্ধে আদালতে মানহানীর মামলা করতে পারি, আপনি জানেন?’
সজীব দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘ভদ্রলোকের মুখোশের আড়ালে আপনার শয়তানী মুখোশের পর্দা আজ আমি খুলে দেবো।’
  পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে সজীব বলতে থাকে, ‘হ্যা, শুনুন। ডাকাত দল যখন অনুপম জুয়েলার্সে হানা দেয়, তখন শরীফ রহমান অপূর্ব সুযোগ দেখতে পান। তিনি সুযোগ বুঝে হারটি নিয়ে সরে পড়েন। পরে একদিন সলিল সাহেব ও শরীফ রহমান গিফট কর্ণার থেকে ঘর সাজানোর উদ্দেশ্যে দু’টি একই রকম মার্বেল পাথরের মূর্তি কিনে এনে শরীফ সাহেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে গল্প গুজব করতে করতে মূর্তিটি ভুল করে রেখে চলে যান। পরে শরীফ রহমান মূর্তি বাড়ি নিয়ে যান। এদিকে শরীফ সাহেব সেই চুরি করা মূল্যবান হারটি মার্বেল পাথরের ভেতর ফাঁকা মূর্তিটার মধ্যে রাখাই আপাতত নিরাপদ মনে করেছিলেন। তাই মূর্তির নিচের দিকের খানিকটা ভেঙে তাতে হারটা রেখে মূর্তির নিচের দিকটা আবার জোড়া লাগিয়ে দেন। এর কয়দিন পর সলিল মিয়া তাঁর মূর্তিটি শরীফ সাহেবের বাসা থেকে জনৈক কাজের লোককে বলে নিয়ে আসেন। পরে যখন শরীফ সাহেব দেখেন ভুল হয়েছে হারটা তার মূর্তির মধ্যে নেই, তখন তার মাথা যায় বিগড়ে! তাহলে সেই মূর্তিটিই সলিল মিয়া নিয়ে গেছেন! পরে তিনি অবশ্য সলিল মিয়ার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বলেন মূর্তিটি তাকে দিয়ে অপর মূর্তিটি নেয়ার জন্যে। কিন্তু সলিল সাহেব অবাক হয়ে বলেন  একই রকম মূর্তি অথচ ওটা ফেরত দিয়ে আরেকটা নেয়ার কথা বলছেন ব্যাপারটা কি! সলিল সাহেব ছিলেন রগচটা স্বভাবের মানুষ। শরীফ রহমানতো সত্যটা প্রকাশ করতে পারবেননা তাই আর কিছু না বলে সেদিন ফেরত যান। আর পরিকল্পনা করেন মূর্তিটি চুরি করার। শরীফ সাহেব  যে সলিল সাহেবের প্রতিষ্ঠানে গিয়েগিলেন মূর্তি ফেরত আনতে এই কথা সলিল সাহেবের প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারীর কাছ থেকে জেনেছি আমি।’
একটুক্ষণ নিরব থেকে আবারও সজীব বলতে লাগলো, ‘এরপর একরাতে শরীফ সাহেব সলিল সাহেবের বাড়ি ঢুকেন মূর্তি চুরি করতে! হঠাৎ সলিল সাহেব জেগে ওঠে চিৎকার করে ওঠেন। আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি হয়তো তিনি শরীফ সাহেবকে চিনেও ফেলেছিলেন তাই সলিল সাহেবকে হত্যা করতে বাধ্য হোন। অপরাধীকে রিমান্ডে নিলেই সব ঘটনা বেরিয়ে আসবে।’
একটুক্ষণ চুপ থেকে আবার সজীব বললো, ‘আমি অনেক কৌশলে শরীফ সাহেবের বাড়ি থেকে মূর্তিসহ হারটা আজই উদ্ধার করি।’
সজীব যেভাবে মূর্তি ও হারটা উদ্ধার করে তার বিস্তারিত বললো। সজীবের কথা শেষ হতেই চমকে ওঠেন শরীফ রহমান। পালানোর চেষ্টা করতেই পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলে।
 সজীব একটি ছোট ব্যাগ সাথে নিয়ে এসেছিলো। ব্যাগের চেইনটা খুলে মূর্তিটি বের করে সবাইকে দেখিয়ে বললো, ‘এই মূর্তিটাই সলিল সাহেবের ঘর থেকে চুরি হয়। এইটি পাওয়া গেছে শরীফ সাহেবের ঘর থেকে।’
সজীব মূর্তির ভেতর থেকে স্বর্ণে মূল্যবান চুনী পাথর বসানো হারটা বের করে তুলির হাতে দেয়।
জিম রহমান প্রশ্ন করেন, ‘যে মেয়েটি তুলির ছদ্মবেশে আমার দোকানে এসেছিলো সে কে?’
সজীব বললো, ‘সেই মেয়েটি ডাকাত দলেরই ভাড়া করা কেউ।’
ডি.সি সাহেব আনন্দিত হয়ে বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল! অসংখ্য ধন্যবাদ সজীব।’
পুলিশ অফিসার বললেন, ‘সত্যি, তোমার তুলনা হয়না সজীব! বয়সে আমাদের চেয়ে ছোট হলেও বিচক্ষণতায় আমাদের চেয়ে পিছিয়ে নও।’
তুলি কৃতজ্ঞপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সজীবের দিকে। মনে মনে ভিষণ পছন্দও করে সজীবকে। ইচ্ছে করছে ওকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু…..! তবু ওর কাছে গিয়ে আলতো করে একটা হাত ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘আমি কিন্তু তোমার হাতটা কখনোই ছাড়তে চাইনা।’
সজীব বিছুটা বিষ্ময় আর কিছুটা অজানা আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো, ‘আমিও চাই, দু’জনে দু’জনার হয়ে বাঁচতে।’
পুলিশ অফিসার সহ কয়েকজন পুলিশ অপরাধী শরীফ রহমানকে এ্যারেষ্ট করে নিয়ে গেলেন। নিমন্ত্রিত অতিথিরাও একে একে বিদায় নিলো।
     ____ সমাপ্ত ____
– রুদ্র অয়ন
ঢাকা, বাংলাদেশ