ছয়
সজীব তার ড্রইং রুমে বসে রয়েছে। নানা রকম চিন্তা ভাবনা এসে, ওর মাথায় জট পাকাচ্ছে। এমন সময় অমর এসে বললো, ‘তুলি খবর পাঠিয়েছে। তোকে যেতে হবে ; চল।’
সজীব তৈরি হয়ে নেয়। গারেজ ঘর থেকে গাড়ি বের করে রওয়ানা দেয় দু’জনে। কিছুক্ষণ পর ওরা ডি.সি সাহেবের বাঙলোর সামনে এসে পৌঁছে। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায় সজীব ও অমর। গাড়ির শব্দ পেয়ে তুলি সদর দরজার কাছে এসে বললো, ‘আসুন।’
তুলি ওদের ভেতরে নিয়ে যায়। গেস্ট রুমে এসে বসলো তিন জনে।
সজীব বলে, ‘এবার বলুন, হঠাৎ তলব করার কারণ?’
‘হারটা উদ্ধারের কাজ কতদূর এগিয়েছে?’
‘তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, আপনার জন্মদিনের আগেই আপনার হারটা উদ্ধার করে দিতে পারবো।’
‘কেসটা আপনার হাতেই দিয়েছি। আমার বিশ্বাস আপনি সফল হবেন।’
এমন সময় কাজের লোক চা নাস্তা দিয়ে গেলো।
তুলি বললো, ‘নিন, শুরু করুন।’
দু’জনকে দু’টো প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা প্লেট নিলো তুলি।
খাওয়া শেষ হলে সজীব জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার জন্মদিন আর কয়দিন বাকী?’
‘আর মাত্র তিন দিন।’
‘ঠিক আছে। চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিরাশ হওয়ার কিছু নেই।’
সজীব যাওয়ার জন্যে ওঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘যদি কিছু মনে না করেন তবে এখন আমরা বিদায় নিই?’
তুলি হাসি মুখে বললো, ‘আপনাদের মতো স্বনামধন্য গোয়েন্দাদের কি আমি বেশিক্ষণ আটকিয়ে রাখতে পারবো? তবে মাঝে মধ্যে বোন মনে করে হোক বা বন্ধু হোক মনে করেই হোক আসবেন কিন্তু।’
সজীব আনন্দিত হয়ে বললো, ‘বোন বা বন্ধুই যখন হলেন তখন “আপনি” করে বলার কি দরকার । বোন বা বন্ধু কি কখনও আপনি করে বলে?’
তুলি বললো, ‘যাক ভাই, আমি খুশি হলাম। ভাই বা বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিতও বটে।’
অমর বললো, ‘দেখ বন্ধু, বোন বন্ধু পেয়ে আমাকে আবার ভুলে যাসনা যেনো!’
ওর কথা শুনে হেসে ওঠলো সবাই।
সজীব ও অমর তুলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর ডি.সি সাহেব এলেন। সাথে পুলিশ অফিসার অজয় শেখ।
দু’জনে গেস্ট রুমে গিয়ে বসলেন।
ডি.সি সাহেব অজয় শেখকে বললেন, ‘আমার মেয়ের জন্মদিনের আর মাত্র তিন দিন বাকি আছে। তার আগে যদি হারটা উপহার না দিতে পারি আর জন্মদিনের পরে যদিও উদ্ধার করে দেন তবে আর কি হবে! আসল আনন্দটাই তো আর থাকবেনা।’
‘আশা করি জন্মদিনের আগেই হারটি উদ্ধার করতে সক্ষম হবো স্যার।’
‘তা যায় বলুন না কেন, আপনাদের ওপর আমার মেয়ে তুলি’র ভরসা বা বিশ্বাস নেই। সেই জন্যে তুলি নিজ থেকেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ সজীবকে ডেকে কেসটা তার হাতে দিয়েছে।’
অজয় শেখ কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, ‘সজীবের হাতে! কই এ কথাতো সজীবের কাছ থেকে শুনিনি!’
ডি.সি সাহেব কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘সেই তরুণ গোয়েন্দা আপনাদের মতো তো আর ঢোল পিটিয়ে বেড়ায় না।’
অজয় অবশ্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ সজীব যখন কেসটা হাতে নিয়েছে তখন কিছুটা চিন্তামুক্ত হলাম স্যার।’
ডি.সি সাহেব বললেন, ‘সজীবের ওপর দেখছি আপনারও বিশ্বাস রয়েছে।’
অজয় শেখ বললেন, ‘আগে বহুবার আমাদের সাহায্য করেছে সে।’
অজয় শেখ যাওয়ার জন্যে ওঠে দাঁড়ালেন।
মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘এবার আমি আসি, স্যার।’
ডি.সি সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, আসুন তা হলে।’
পুলিশ অফিসার অজয় শেখ বিদায় নিয়ে চলে যেতেই তুলি গেস্ট রুমে প্রবেশ করে ডি.সি সাহেব কে বললো, ‘পুলিশ অফিসার অজয় আংকেল কি বললেন বাবা?’
‘বললেন, যথাসাধ্য তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন।’
‘তা যায়ই বলোনা কেন বাবা, পুলিশ আংকেল যে সফল হবেন এই আশা অত্যান্ত ক্ষীণ। এই দেশের পুলিশ কাজেরই না। অবশ্য দু’একজন যে ব্যতিক্রম নয় তা নয়। কিন্তু অধিকাংশই নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্থ, অনৈতিক কাজে জড়িত। এরা শুধুই সরকারের অন্য ধ্বংস করে। আর ঘুষ খেতে পটু। পুলিশ জনতার জান মালের নিরাপত্তা সেবার জন্যেই রয়েছে। কিন্তু কয়জন পুলিশ সাধারণ মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠতে পেরেছে! আজকালতো হীন স্বার্থে নিরপরাধ মানুষকেও ইয়াবা বা মাদব দিয়ে ফাঁসিয়েছে ওরা! পত্র পত্রিকায় তাদের কত যে অপরাধের দলিল রয়েছে তার হিসেব নেই! কয়টার সুরাহা হয়েছে? সম্প্রতি সিনহা হত্যার পেছনেও পুলিশের হাত রয়েছে এটা সবাই বুঝে গেছে। সাগর – রুনি হত্যার কোনও সুরাহা হলোনা! তনু, নুসরত, রিফাত, বিশ্বজিত,
তানিয়া,রিয়াদ,খাদিজা এছাড়াও আরও কত শত কেসের নেপথ্য কাহিনি, ন্যায় বিচার আজও হলোনা!’
‘তারপরও ভালো কিছু লোক পুলিশ, প্রশাসনে রয়েছে এটা কি তুমি অস্বীকার করো মা?’
‘না অস্বীকার করিনা। কিন্তু সংখ্যায় অত্যান্ত নগন্য। আর শত সহস্র দুর্নীতিগ্রস্থ, ঘুষখোর, ধান্দাবাজদের ভীড়ে ভালো, সৎদের সংখ্যা এতোই নগণ্য যে সাধারণত মানুষ পুলিশের কাছে সহজে যেতে চায়না! তাদের বন্ধু মানতে চায়না।’
ডি.সি সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়েও আর বললেননা।
তুলি আবারও বলতে লাগলো, ‘আমি পুলিশের চেয়ে সজীবকেই বেশি বিশ্বাস করি বাবা। আমার বিশ্বাস সজীব সফল হবে। তুমি আসার কিছুক্ষণ আগে সজীবকে ডেকেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কাজের কতদূর? উত্তরে বললো, এগিয়ে যাচ্ছি, হতাশার কিছু নেই। আমার বিশ্বাস সে সফল হবে।’
‘তা হলে আমি খুব আনন্দিত হবো।’
ডি.সি সাহেব গেস্ট রুমে থেকে বেরিয়ে তাঁর নিজস্ব রুমের দিকে গেলেন।
সাত
মাইক্রো বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সজীব ও অমর। এক সময় ওরা শরীফ রহমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে এসে পৌঁছে। গাড়ি থেকে নেমে ওরা এগিয়ে গেলো শরীফ রহমানের অফিস কক্ষের দিকে।
ভেতরে প্রবেশ করতেই শরীফ রহমান অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘আসুন আপনারা। তারপর কি মনে করে?’
সজীব বললো, ‘তেমন কারণ নেই বলতে পারেন। এই পথ ধরে যাচ্চিলাম, ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই।’
‘তা বসুন।’ বললেন শরীফ রহমান।
সজীব বললো, ‘আমাদের একটু অন্য কাজ আছে, বেশিক্ষণ বসতে পারছিনা আজ। আচ্ছা, আপনার বাড়ির ঠিকানাটা একটু লিখে দিবেন প্লিজ? রাতে এক সময় ফ্রি থাকলে আলাপ আলোচনা, গল্প আড্ডা করে আসতাম এই আরকী।’
শরীফ রহমান একটা প্যাডের পাতায় খস্ খস্ করে তাঁর বাড়ির ঠিকানা লিখে সজীবের হাতে দিলেন।
সজীব ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে ওঠে এলো। সাথে অমরও।
ঠিকানাটা দেখে বিস্মিত হয় সজীব! আশ্চর্য! সেই যে একদিন পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে গাড়িতে যে চিঠিটা পেয়েছিলো সে চিঠির হাতের লেখার সাথে শরীফ সাহেবের হাতের লেখার হুবহু মিল!
সজীব বললো, আমার মনে হচ্ছে, সলিল সাহেবের হত্যার সাথে শরীফ সাহেব জড়িত।’
অমর শরীফ সাহেবের হাতের লেখাটা দেখতে দেখতে বললো, ‘আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।’
কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবার অমর বললো, ‘শোন, শরীফ সাহেবের বাসায় গিয়ে সেই মার্বেল পাথরের মূর্তিটা কৌশলে খুঁজে বের করতে হবে। মনে হচ্ছে ওটাতেই একটা রহস্য লুকিয়ে আছে।’
সজীব ধীর কণ্ঠে বললো, ‘চল, এখন আমরা শরীফ সাহেবের বাসায় যাই। তিনি এখন বাসায় নেই, এই সুযোগ। বাসার কাজের লোকদের কৌশলে পটিয়ে পাটিয়ে মূর্তিটি হাসিল করা যায় কি না দেখি গিয়ে।’
অমর সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘হুম, চল তাহলে।’
শরীফ সাহেবের বাস ভবন খুঁজে বের করতে বেশি বেগ পেতে হলোনা। বাসার কাছাকাছি একজন পথিককে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো। গাড়ি শরীফ সাহেবের বাস ভবনের গেটের সামনে এসে থামতেই একজন মধ্য বয়স্ক কাজের লোক বের হয়ে এসে বললো, ‘কাকে চান?’
সজীব কিছুটা গাম্ভীর্যের স্বরে বললো, ‘বিশেষ কাজে শরীফ সাহেব আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন।’
অমর চালাকি করে বললো, ‘শরীফ সাহেব আমার বাবার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’
লোকটি বললো, ‘তা বেশ। আপনাদের প্রয়োজনটা কি বলবেন?’
সজীব বললো, বাসায় নাকি শরীফ সাহেবের একটি মার্বেল পাথরের মূর্তি রয়েছে? মূর্তিটি শরীফ সাহেব চেয়ে পাঠিয়েছেন।’
লোকটি মনে মনে বললো, ‘মূর্তিটি না চেয়ে পাঠালে এরা মূর্তির কথা কি করে জানবে! একটা মূর্তিই তো। মহামূল্যবান কোনও জিনিসতো নয়।
লোকটি মৃদু হেসে বললো, ‘হ্যা, হ্যা। বাবুজির শোবার ঘরে আলমারিতেই মূর্তিটি রাখা আছে। সেটিতো আমাদের বাবুজি রোজই দেখেন। সামান্য একটা মূর্তির মাঝে যে তিনি কি পান তিনিই জানেন। আচ্ছা, আপনারা একটু দাঁড়ান আমি ওটা এনে দিচ্ছি।’
লোকটি ভেতরে প্রবেশ করে কি জানি কি মনে করে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সলিল সাহেবকে ফোন দিলো…। না। তিনি ফোন ধরছেন না! আজকাল নিম্ন শ্রেণির কাজের লোকদের ফোন বড় বাবুরা সহজে ধরতেই চাননা! যাকগে একটি মার্বেল পাথরের মূর্তিই তো। ভেতরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ পর মূর্তিটি হাতে নিয়ে ফিরে আসে। তারপর সজীবের হাতে দেয়।
সজীব ধন্যবাদ জানিয়ে বললো, ‘আমরা তবে আসি, চাচা।’
লোকটি মাথা নেড়ে বললো, ‘ঠিক আছে বাবুরা এসো।’
বিদায় নিয়ে ওরা গাড়িতে ওঠে এলো। সজীব গাড়ি ড্রাইভ করছে। অমর মূর্তিটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই মূর্তির ভেতর থেকে কেমন একটা শব্দ হলো! অমর বুঝলো মূূর্তিটির ভেতরের অংশ ফাঁকা। নিচের দিকে দেখলো জোড়া লাগানোর দাগ! নিশ্চয় মূর্তির ভেতর কিছু ভরে রাখা হয়েছে। এরপর নিচের দিকটা আবার জোড়া দেয়া হয়েছে! সজীবের হাতে মূর্তিটা দিয়ে অমর বললো, ‘নিশ্চয় এর ভেতর কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে।’
সজীব একহাতে স্টিয়ারিং ধরে অপর হাতে মূর্তিটি নাড়াচাড়া করে দেখে বললো, ‘হুম। তাইতো মনে হচ্ছে!’
এক সময় ওরা বাসার সামনে এসে পৌঁছে। সজীব ও অমর গাড়ি থেকে নেম বাসার ভেতরে প্রবেশ করে।
বসার ঘরে এসে দু’জনে বসে পড়ে। সজীব মূর্তিটির একেবারে নিচের দিকে যেখানে জোড়া লাগানোর দাগ রয়েছে সেখানে হাতুড়ি দিয়ে ভাঙতে থাকে। নিচের কিছু অংশ ভেঙে যেতেই চমকে ওঠে সজীব! মূর্তির ভেতরে স্বর্ণে মূল্যবান চুনী পাথর বসানো একটি হার! অমরের হাতে মূর্তিটা দিয়ে সজীব বললো, ‘আমরা সত্যিই দারুণ চাল চেলেছি।’
অমর উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো, ‘এক ঢিলে দুই পাখি। প্রথমত, তুলি’র হার উদ্ধার ; দ্বিতীয়ত সলিল মিয়ার হত্যার আসামি গ্রেফতার।’
সজীব সেলফোনটা পকেট থেকে বের করে তুলির বাসার ল্যান্ড ফোনে কল করে। ফোন রিসিভ করলো তুলি। সজীব উচ্ছ্বাসের স্বরে বলে, ‘হ্যালো, তুলি?… ইমিডিয়েট আজ দুপুরে পার্টির আয়োজন করুন প্লিজ। পরিচিত সবাইকে নিমন্ত্রণ করুন।….. হ্যা, বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ …. আমি পার্টিতে বিস্তারিত সব বলবো । এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।….. হ্যা, আমি আসছি।… আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
ফোন রেখে দেয় সজীব।
ক্রমশ দুপুর গড়িয়ে এলো। গন্তব্য স্থানে রওয়ানা দেয় সজীব । সাথে অমর।
এক সময় ওরা ডি.সি সাহেবের বাঙলোয় পার্টি রুমে এসে উপস্থিত হয়। নিমন্ত্রিত প্রায় সবাই উপস্থিত হয়েছেন। দুপুর দু’টো। শুরু হলো আপ্যায়নের পালা। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সজীব চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর পার্টি রুমের মঞ্চে ডেস্ক টেবিলের সামনে মাইক্রো ফোনে শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘সম্মানিত অতিথি বৃন্দ, আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি শ্রদ্ধেয় ডি.সি স্যারের মেয়ের হার এবং সলিল হত্যাকারীকে চিহ্নিত এবং গ্রেফতার করতে।’
একটু থেমে আবার বললো, ‘সম্মানিত সুধী মন্ডলী, আপনারা সকলেই অবগত আছেন, অনুপম জুয়েলার্স অর্থাৎ জিম রহমান সাহেবের দোকানে ডাকাত দল আতর্কিত হামলা চালিয়ে একটি চুনী পাথরের মূল্যবান স্বর্ণের হার লুণ্ঠন করে পালিয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ডাকাত দল হারটি লুণ্ঠন করতে পারেনি।’
ডি.সি সাহেব বললেন, ‘তাহলে?’
সজীব আগের মতোই শান্ত কণ্ঠে বললো, ‘হারটি চুরি করেছেন ডাকাত দল যখন প্রবেশ করে তখন যিনি উপস্থিত ছিলেন।’
জিম রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘শরীফ রহমান!’
সজীব দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘হ্যা, শরীফ রহমানই চুরি করেছিলেন।’
শরীফ রহমান চিৎকার করে বললেন, ‘কাল্পনিক মন্তব্য কেন করছেন! প্রমাণ দিতে পারবেন?’
সজীব দৃঢ় স্বরে বলে, ‘বিনা প্রমাণে কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করা আমার কর্ম নয়।’
শরীফ রহমান গর্জে ওঠে বললেন, ‘একজন ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে মিথ্যে রটনার জন্যে আপনার বিরুদ্ধে আদালতে মানহানীর মামলা করতে পারি, আপনি জানেন?’
সজীব দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘ভদ্রলোকের মুখোশের আড়ালে আপনার শয়তানী মুখোশের পর্দা আজ আমি খুলে দেবো।’
পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে সজীব বলতে থাকে, ‘হ্যা, শুনুন। ডাকাত দল যখন অনুপম জুয়েলার্সে হানা দেয়, তখন শরীফ রহমান অপূর্ব সুযোগ দেখতে পান। তিনি সুযোগ বুঝে হারটি নিয়ে সরে পড়েন। পরে একদিন সলিল সাহেব ও শরীফ রহমান গিফট কর্ণার থেকে ঘর সাজানোর উদ্দেশ্যে দু’টি একই রকম মার্বেল পাথরের মূর্তি কিনে এনে শরীফ সাহেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে গল্প গুজব করতে করতে মূর্তিটি ভুল করে রেখে চলে যান। পরে শরীফ রহমান মূর্তি বাড়ি নিয়ে যান। এদিকে শরীফ সাহেব সেই চুরি করা মূল্যবান হারটি মার্বেল পাথরের ভেতর ফাঁকা মূর্তিটার মধ্যে রাখাই আপাতত নিরাপদ মনে করেছিলেন। তাই মূর্তির নিচের দিকের খানিকটা ভেঙে তাতে হারটা রেখে মূর্তির নিচের দিকটা আবার জোড়া লাগিয়ে দেন। এর কয়দিন পর সলিল মিয়া তাঁর মূর্তিটি শরীফ সাহেবের বাসা থেকে জনৈক কাজের লোককে বলে নিয়ে আসেন। পরে যখন শরীফ সাহেব দেখেন ভুল হয়েছে হারটা তার মূর্তির মধ্যে নেই, তখন তার মাথা যায় বিগড়ে! তাহলে সেই মূর্তিটিই সলিল মিয়া নিয়ে গেছেন! পরে তিনি অবশ্য সলিল মিয়ার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বলেন মূর্তিটি তাকে দিয়ে অপর মূর্তিটি নেয়ার জন্যে। কিন্তু সলিল সাহেব অবাক হয়ে বলেন একই রকম মূর্তি অথচ ওটা ফেরত দিয়ে আরেকটা নেয়ার কথা বলছেন ব্যাপারটা কি! সলিল সাহেব ছিলেন রগচটা স্বভাবের মানুষ। শরীফ রহমানতো সত্যটা প্রকাশ করতে পারবেননা তাই আর কিছু না বলে সেদিন ফেরত যান। আর পরিকল্পনা করেন মূর্তিটি চুরি করার। শরীফ সাহেব যে সলিল সাহেবের প্রতিষ্ঠানে গিয়েগিলেন মূর্তি ফেরত আনতে এই কথা সলিল সাহেবের প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারীর কাছ থেকে জেনেছি আমি।’
একটুক্ষণ নিরব থেকে আবারও সজীব বলতে লাগলো, ‘এরপর একরাতে শরীফ সাহেব সলিল সাহেবের বাড়ি ঢুকেন মূর্তি চুরি করতে! হঠাৎ সলিল সাহেব জেগে ওঠে চিৎকার করে ওঠেন। আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি হয়তো তিনি শরীফ সাহেবকে চিনেও ফেলেছিলেন তাই সলিল সাহেবকে হত্যা করতে বাধ্য হোন। অপরাধীকে রিমান্ডে নিলেই সব ঘটনা বেরিয়ে আসবে।’
একটুক্ষণ চুপ থেকে আবার সজীব বললো, ‘আমি অনেক কৌশলে শরীফ সাহেবের বাড়ি থেকে মূর্তিসহ হারটা আজই উদ্ধার করি।’
সজীব যেভাবে মূর্তি ও হারটা উদ্ধার করে তার বিস্তারিত বললো। সজীবের কথা শেষ হতেই চমকে ওঠেন শরীফ রহমান। পালানোর চেষ্টা করতেই পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলে।
সজীব একটি ছোট ব্যাগ সাথে নিয়ে এসেছিলো। ব্যাগের চেইনটা খুলে মূর্তিটি বের করে সবাইকে দেখিয়ে বললো, ‘এই মূর্তিটাই সলিল সাহেবের ঘর থেকে চুরি হয়। এইটি পাওয়া গেছে শরীফ সাহেবের ঘর থেকে।’
সজীব মূর্তির ভেতর থেকে স্বর্ণে মূল্যবান চুনী পাথর বসানো হারটা বের করে তুলির হাতে দেয়।
জিম রহমান প্রশ্ন করেন, ‘যে মেয়েটি তুলির ছদ্মবেশে আমার দোকানে এসেছিলো সে কে?’
সজীব বললো, ‘সেই মেয়েটি ডাকাত দলেরই ভাড়া করা কেউ।’
ডি.সি সাহেব আনন্দিত হয়ে বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল! অসংখ্য ধন্যবাদ সজীব।’
পুলিশ অফিসার বললেন, ‘সত্যি, তোমার তুলনা হয়না সজীব! বয়সে আমাদের চেয়ে ছোট হলেও বিচক্ষণতায় আমাদের চেয়ে পিছিয়ে নও।’
তুলি কৃতজ্ঞপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সজীবের দিকে। মনে মনে ভিষণ পছন্দও করে সজীবকে। ইচ্ছে করছে ওকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু…..! তবু ওর কাছে গিয়ে আলতো করে একটা হাত ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘আমি কিন্তু তোমার হাতটা কখনোই ছাড়তে চাইনা।’
সজীব বিছুটা বিষ্ময় আর কিছুটা অজানা আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো, ‘আমিও চাই, দু’জনে দু’জনার হয়ে বাঁচতে।’
পুলিশ অফিসার সহ কয়েকজন পুলিশ অপরাধী শরীফ রহমানকে এ্যারেষ্ট করে নিয়ে গেলেন। নিমন্ত্রিত অতিথিরাও একে একে বিদায় নিলো।
____ সমাপ্ত ____
– রুদ্র অয়ন
ঢাকা, বাংলাদেশ