রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতায় ঝুলে রয়েছে গৃহকর্মী সুমির বিচার

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

বাবা-মাকে হত্যার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ঐশী রহমানের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু একই ঘটনায় কিশোর আইনে মামলায় সাড়ে চার বছরেও শেষ হয়নি বাসার গৃহকর্মী সুমি আক্তারের বিচার।

মামলাটির বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশ সুমির আইনজীবী। তার অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতার কারণেই সুমির মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। রাষ্ট্রপক্ষ ইচ্ছা করলে মামলা দুইটির কাযক্রম একই সঙ্গে শেষ করত পারেতো।

তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, মামলার সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসতে চায় না।যার ফলে মামলাটি ঝুলে রয়েছে।

সুমির আইনজীবী রাজধানী মানবাধিকার সংস্থার মহাসচিব সৈয়দ নাজমুল হুদা বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতার জন্য গৃহকর্মী সুমির মামলাটি ঝুলে রয়েছে। রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে তা দ্রুত শেষ করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, মামলার রায় যেটা হবে তা মেনে নিবো। সুমি কত দিন এভাবে আদালতে আসা-যাওয়া করবে। তারও তো একটা জীবন আছে।

রাষ্টপক্ষের আইনজীবী শাহাবউদ্দিন মিয়া বলেন, সুমির মামলায় আদালতে সাক্ষীদের সমন দেয়া হয়েছে। মামলায় ৪৯ সাক্ষীর মধ্যে ২৩ জনের সাক্ষ্য হয়েছে। অপর সাক্ষীরা আদালতে হাজির না হওয়ায় জামিন আযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আগামী ৮ মার্চ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। আশা করছি ওই দিন সাক্ষীর কার্যক্রম শেষ হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগে নিজের বাসা থেকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মা-বাবা খুন হওয়ার পর পালিয়ে যায় ঐশী। এ ঘটনায় ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। একই বছরের ১৭ আগস্ট ঐশী রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এরপর ২৪ আগস্ট আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন ঐশী।

২০১৪ সালের ৯ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আবুল খায়ের মাতুব্বর আসামিদের বিরুদ্ধে দুটি পৃথক চার্জশিট দেন। সুমি অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় কিশোর আইনে এবং ঐশীসহ তিন জনের বিরুদ্ধে আলাদা চার্জশিট দেন। সুমির মামলার বিচার কাযক্রম কিশোর আদালতে পরিচালনা হচ্ছে।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধান আসামি ঐশী রহমানকে ডাবল মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার ৪নং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। অপর দুই আসামি ঐশীর বন্ধু রনিকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও জনিকে খালাস দেয়া হয়।

২০১৭ সালের ৫ জুন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ঐশীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দেন হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।

এরপর ২২ অক্টোবর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৭৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে ঐশীর সাজা কমানোর ক্ষেত্রে পাঁচটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, সে (ঐশী) অস্বস্তিবোধ করছিল। তদন্তের সময় যখন তাকে (ঐশী) কোনো এক ব্যক্তি খারাপ উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলেছিল, সে কারণে ঐশী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।

এক. সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়াই এবং মানসিক বিচ্যুতির কারণেই ঐশী জোড়া খুনের ঘটনা ঘটায় এবং সে অ্যাজমা, ওভারি সিস্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত।

দুই. তার (ঐশী) দাদি এবং মামাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।

তিন. ঘটনার সময় তার বয়স ১৯ বছরের কাছাকাছি, তখন সে সাবালকত্ব পেয়েছে মাত্র।

চার. ঐশীর বিরুদ্ধে অতীতে ফৌজদারি অপরাধের কোনো (ফৌজদারি মামলা) রেকর্ড নেই।

পাঁচ. ঘটনার দুই দিন পরই সে (ঐশী) স্বেচ্ছায় থানায় আত্মসমর্পণ করে।

রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়। এটি কার্যকর করলেই যে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে যাবে, তেমনটি নয়। বরং কম সাজাও অনেক সময় সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে সুস্পষ্টভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিচারিক আদালতের রায় সম্পর্কে বলা হয়, সামাজিক অবক্ষয় বিবেচনায় নিয়ে বিচারিক আদালত কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে রায় দেন, যেখানে বলা হয়েছে, একটি মেয়ে তার বাবা-মাকে নিজের হাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার সাহস দেখিয়েছে। তবে সাজা নির্ধারণ ও বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের আবেগ প্রদর্শনের সুযোগ নেই। কেননা আদালত আইনগত দিকগুলো ও প্রমাণাদি বিবেচনায় নেবে, কী পরিস্থিতিতে ঘটনাটি ঘটেছে, যেখানে একজন নারী ১৯ বছর বয়সে ওই কর্মকাণ্ড করেছে।