রানি এলিজাবেথ-প্রিন্স ফিলিপের রাজকীয় প্রেমের উপাখ্যান

:
: ২ years ago

ব্রিটেনকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি এই রানি ৯৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) রানির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বাকিংহাম প্যালেস।

দীর্ঘ এই শাসনামলে এলিজাবেথের সবচেয়ে কাছের মানুষ, তার প্রিয় সঙ্গী ছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। ‘ডিউক অব এডিনবারা’ খেতাবধারী প্রিন্স ফিলিপ ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল ৯৯ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুতে একা হয়ে পড়েন রানি। তাদের প্রেম কাহিনী নিয়েও আগ্রহের শেষ নেই।

রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন একবার বলেছিলেন, সারাবিশ্বে প্রিন্স ফিলিপ একমাত্র মানুষ যিনি রানিকে অন্য একজন মানুষ হিসেবে দেখেন, সেভাবেই আচরণ করেন। একমাত্র তিনিই এটা করতে পারেন।

তাদের ছিল প্রেমের বিয়ে। তারা দুজন দুজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। তাদের দেখা হয়েছিল বিয়ের অনেক আগেই। ডার্টমথ নেভাল কলেজে ১৯৩৯ সালে তোলা একটি ছবি দেখে বোঝা যায় রাজকীয় এই প্রেম-প্রণয়ের সূচনা তখন থেকেই।

প্রিন্স ফিলিপ তখন ১৮ বছরের সুদর্শন চনমনে নেভাল ক্যাডেট। বাবা-মার সঙ্গে ওই কলেজে সফরে গিয়ে ১৩ বছরের রাজকুমারী এলিজাবেথের নজর কাড়েন তিনি। কৈশোরের সেই আকর্ষণ ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে রূপ নেয়। দুজন দুজনকে চিঠি লিখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হঠাৎ মাঝেমধ্যে দেখাও হতো দুজনের।

প্রিন্স ফিলিপ যখন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, রাজকুমারী তার ঘরে প্রিন্স ফিলিপের একটি ছবি রেখেছিলেন। গ্রিস এবং ডেনমার্কের এই রাজকুমারের ছেলেবেলা ছিল অনেকটা যাযাবরের মতো।

তার জন্ম গ্রিসের রাজপরিবারে, কিন্তু নির্বাসিত হওয়ায় ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরতে হয়েছে তাকে। এ কারণে অল্প বয়স থেকে তিনি ছিলেন অনেক স্বাবলম্বী এবং শক্ত মনের। রাজকুমার হলেও রাজপ্রাসাদের ছায়া তার ওপর ছিল না।

রাজকুমারী এলিজাবেথ ছিলেন ঠিক তার বিপরীত। তার জন্ম এবং বড় হওয়া ছিল রাজপ্রাসাদের সুরক্ষিত বেষ্টনীর ভেতর। বাইরের জীবনের বাস্তবতার সাথে তার পরিচয় ছিল খুবই সামান্য। চুপচাপ লাজুক স্বভাবের ছিলেন তিনি। যে কোনো বিষয় নিয়ে অনেক ভাবতেন। ফলে ভিন্ন প্রকৃতির হলেও তারা দুজন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন।

রাজকুমারীর বয়স যখন ২০ বছর, প্রিন্স ফিলিপ বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার এক বছর পর ১৯৪৭ সালে এলিজাবেথের ২১তম জন্মদিনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বাগদানের কথা প্রকাশ করা হয়।

ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে গির্জায় দুই হাজার অতিথির সামনে তাদের বিয়ে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র দুবছর আগে। ব্রিটেন তখনও সেই ধাক্কা সামলাতে বিপর্যস্ত। সেই কঠিন সময়ে তাদের বিয়ে নিয়ে অনেকদিন পর ব্রিটিশরা উৎসব করেছিলেন। উইনস্টন চার্চিল তাদের বিয়ে সম্পর্কে বলেছিলেন, এই কঠিন সময়ে এ যেন এক রঙের ঝলকানি।

রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা পালনে রানিকে সব সময়ই সাহায্য করেছেন ডিউক। অন্যদিকে পরিবারের প্রধানের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে।

জাতীয় সব বড় বড় অনুষ্ঠানে সবসময় রানির পাশে থেকেছেন প্রিন্স ফিলিপ। বিদেশ সফরেও স্ত্রীর সাথে যেতেন তিনি। এসব অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ফুটেজে দেখা যায় হঠাৎ দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হচ্ছে এবং দুজনের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক।

২০১৭ সালে প্রিন্স ফিলিপ রাজকীয় দায়-দায়িত্ব থেকে অবসর নেন। ফলে তখন থেকে বহু অনুষ্ঠানেই রানিকে হয় একা অথবা রাজপরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে নিয়ে হাজির হতে দেখা যায়।

আনুষ্ঠানিকতা, রাজকীয় কায়দা কানুন তেমন পছন্দ করতেন না প্রিন্স ফিলিপ। রাজকীয় পোশাক পরে কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে দু-চারটে কথা বলার বাইরে তিনি পড়তে এবং লিখতে পছন্দ করতেন। ছবিও আঁকতেন।

দায়িত্বের কারণে রানিকে অধিকাংশ সময় লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে থাকতে হতো। সন্দেহ নেই যে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু অধিকাংশ সময় দুজনে দুই জায়গায় থাকতেন।

২০২০ সালের মার্চ থেকে প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ বিবাহিত জীবনের শেষ দিনগুলোতে তারা সর্বক্ষণ একসঙ্গেই ছিলেন। প্রসাদের চার দেয়ালের মধ্যে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের নানা স্মৃতি ছিল তাদের। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তারা ছিলেন একে অন্যের সুখ-দুঃখের সাথী। কখনই তারা নিজেদের ভালোবাসা লোকসমক্ষে দেখাননি। কিন্ত ইতিহাসে রানি এলিজাবেথ এবং প্রিন্স ফিলিপ অসামান্য এক রাজকীয় প্রেমের উপাখ্যান হয়েই থাকবেন।