রাজীব হোসেন যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, তখন মাকে হারান। অষ্টম শ্রেণিতে উঠতে না–উঠতেই বাবাও চলে যান না–ফেরার দেশে। যক্ষের ধনের মতো রাজীবকে আগলে রাখেন বড় খালা জাহানারা বেগম। সব বাধা পেরিয়ে কষ্টেসৃষ্টে রাজীবও এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাসের বেপরোয়া গতির মুখে পড়ে ডান হাত হারানো রাজীবের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন শঙ্কায় স্বজনেরা। এতিম এই ছেলেটিকে জীবনভর কে দেখবে, তা ভেবেই যেন দিশেহারা তাঁরা।
বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গত মঙ্গলবার গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১)। হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎই পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে পেরিয়ে যাওয়ার বা ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিক গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাজীবকে ভর্তি করা হয় পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভবপর নয় বলে গতকাল বুধবার বিকেলে রাজীবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
এদিকে রাজীব হোসেনের চিকিৎসার সব ব্যয় বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ ও স্বজন পরিবহন কর্তৃপক্ষকে বহন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গতকাল রুলসহ এ আদেশ দেন। রুলে ক্ষতিগ্রস্ত রাজীব হোসেনকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ‘দুই বাসের রেষারেষি, হাত গেল কলেজছাত্র রাজীবের’ শিরোনামে গতকাল প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটিসহ গণমাধ্যমে আসা তিনটি প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস গতকাল রিটটি করেন।
আদেশের বিষয়টি জানিয়ে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, যাত্রীসাধারণের চলাচল নিরাপদ করতে ট্রাফিক আইনসহ বিদ্যমান সংশ্লিষ্ট আইন কঠোরভাবে কার্যকর করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনে আইন সংশোধন ও নতুন করে বিধিমালা প্রণয়নের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রসচিব, সড়ক পরিবহনসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ আট বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজীবই সবার বড়। মিরহাজিরবাগে একটি মেসে থেকে পড়াশোনা করেন। কখনো টিউশনি, কখনো কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে পড়ালেখার খরচ চালাতেন। মামা-খালারাও এগিয়ে আসতেন সুযোগ-সুবিধামতো। ছোট দুই ভাই যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসার এতিমখানায় থেকে পড়াশোনা করছে।
রাজীবের এই দুর্ঘটনায় চোখের পানি থামছেই না খালা জাহানারা বেগমের। গতকাল দুপুরে শমরিতা হাসপাতালের করিডরে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তখন বারবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠছিলেন তিনি। চোখের পানি বাঁধ মানছিল না মামা জাহিদুল ইসলাম ও খালা খাদিজা বেগমেরও।
জাহানারা বেগম বলছিলেন, ‘ছেলেটা কখনো কিছুর জন্য আবদার করেনি। যা দিয়েছি তা-ই খেয়েছে, তা-ই পরেছে। পড়াশোনা শেষ হলে চাকরি শুরুর গল্প শুরু করেছিল কিছুদিন যাবৎ। ছেলেটার কষ্টেরও দিন শেষ হলো—এমনটা ভাবা শুরু করেছিলেন তাঁরাও। পরিচিতজনদের বলে রেখেছিলেন ভালো চাকরির সন্ধান দিতে। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশই উল্টে গেল।’
জাহানারা বেগম বলেন, ‘রাজীব ডান হাত দিয়েই লিখত। এখন সে কীভাবে পড়াশোনা শেষ করবে, কেই-বা তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে, চিকিৎসা শেষে হাত হারানো এই ছেলটিকে কেই-বা দেখাশোনা করবে—এসব ভেবে দিশেহারা তাঁরা।’
শমরিতা হাসপাতালে রাজীবের চিকিৎসা ব্যয়ের বিল এক দিনেই দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। স্বজনেরা সব টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকা পরে দেবেন—এমন লিখিত দেওয়ার পর বিকেলে রাজীবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।
রাজীবের চাচা পুলিশের পরিদর্শক আল আমিন বলেন, ছেলেটা কোনো কথা বলছে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে ব্যথায় ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দিচ্ছে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. শামছুজ্জামান বলেন, অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাঁর অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল, তবে শঙ্কামুক্ত নয়। যেকোনো সময় আবার খারাপ হয়েও যেতে পারে। চিকিৎসকেরা তাঁর সার্বক্ষণিক খবর রাখছেন।
দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহেদ আলী এবং স্বজন বাসের চালক খোরশেদকে গ্রেপ্তার করেছে শাহবাগ থানার পুলিশ। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, রাজীব নিজেই বাদী হয়ে গতকাল মামলা করেছেন। দুই চালককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দুই বাসচালক বলেছেন, ট্রাফিক সিগন্যাল ওঠার পরপরই দ্রুতগতিতে বাস চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তবে তাঁরা কেউই দায় স্বীকার করেননি।
সড়ক দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই ঢাকার
বাংলাদেশ পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল—এই ১৬ বছরে কেবল রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৫ হাজার ৬৫৪ জন। তাদের অধিকাংশই মারা গেছে সড়ক পারাপারের সময়। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা রাজধানীতে দুর্ঘটনার জন্য চালক ও পথচারীদের সতর্কতা এবং যানবাহনের বেপরোয়া গতিকেই দায়ী করছেন।
পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। এআরআই ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজধানীর মোড়গুলোতে দুর্ঘটনার প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করেছে। গবেষণায় দেখা যায়, সবচেয়ে প্রাণঘাতী স্থান হচ্ছে ৫৪টি ব্যস্ত মোড়। ছয় বছরে এসব মোড়ে প্রাণ গেছে ১৮১ জনের। এর মধ্যে ১৩৫ জন পথচারী।
দেশের সব মহানগরে যত পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, এর দ্বিগুণের বেশি মারা যায় শুধু ঢাকা মহানগরে। অবশ্য ঢাকায় মানুষ ও যানবাহন—দুটোই বেশি। সারা দেশের মহানগরগুলোতে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই ঢাকার। নিহত পথচারীদের ৭২ শতাংশ ঢাকায়।
এআরআইয়ের গবেষণা বলছে, মোড়গুলোতে দুর্ঘটনার পেছনে ৬৪ শতাংশই চালকের অসতর্কতা দায়ী। ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে পথচারী নিজেই দায়ী, আর ২৮ শতাংশ অন্যান্য কারণে ঘটে।
এআরআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, রাজধানীর প্রাণঘাতী ব্যস্ত ৫৪টি মোড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ৯টি মোড়। এগুলো হচ্ছে উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়ক মোড়, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কারওয়ান বাজার, বনানীর কাকলী, বিজয় সরণি, জোয়ার সাহারা ও শ্যামলী।
তবে পুলিশ ও পরিবহন সংগঠনগুলোর সূত্র বলছে, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়ক চালুর পর সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী মোড়ে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কিছুটা কমে এসেছে।
জানতে চাইলে এআরআইয়ের গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ঢাকায় একই রুটে একাধিক পরিবহন কোম্পানি। আবার একই কোম্পানিতে একাধিক মালিক। দিন শেষে মুনাফা যার যার। এটা খুবই বাজে ব্যবস্থা। এর ফলে একটা অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। যার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শৃঙ্খলা আনতে হলে সব বাস একটি বা অল্প কিছু কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসতে হবে। চালকদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার সময় এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চালক প্রশিক্ষণে ক্লাস নেন। ওই ক্লাসে ব্যক্তিগত গাড়ির চালকেরাই আসেন। গণপরিবহনের চালকেরা আসেন না। তাঁদের আনতে চাইলে ধর্মঘটের হুমকি দেন। চালকদের প্রশিক্ষণ, দ্রুত ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে সড়ক নিরাপদ করা যাবে না।