১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলায় জন্মগ্রহণ করা সাহারা খাতুন ১৯৬০ সালে ইস্ট-পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর তিনি সিটি নাইট কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর জগন্নাথ কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন। স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষার সময় অসুস্থ থাকার কারণে এক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে চাচা মরহুম আবুল হাশেমের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি চলে যান। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরেজি মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
১৯৬৭ সালে সাহারা খাতুন পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং পুরোদমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। পরে ফের করাচি গিয়ে রেজাল্ট নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। সেটি ছিল সাহারা খাতুনের জীবনের প্রথম নির্বাচন। তারপর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এত বেশি জড়িয়ে পড়েন যে আর ল’ পরীক্ষা সময়মতো দেয়া সম্ভব হয়নি।
তার রাজনীতির হাতেখড়ি বাবার কাছ থেকেই। বাবা পল্টন ময়দানে বড় বড় জনসভায় তাকে অনেক সময় নিয়ে যেতেন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা যখন গঠিত হলো তাতে তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ শুরু করেন এবং সারা ঢাকা শহরে নারীদের আইভী রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত করতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা গঠন করে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই মিটিং মিছিল সবকিছুতেই অংশ গ্রহণ করেন তিনি। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দিনও তিনি সরাসরি অংশ গ্রহণ করেছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে তখনকার ছাত্রলীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দিন তিনি আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার অনেক নেতাকর্মীকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন । তিনিসহ নারী কর্মীরা সেদিন মঞ্চের সামনে খুব কাছাকাছি বসেছিলেন। সে দিন সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং তিনি নিজেও ট্রেনিং গ্রহণ করেন। কিছুদিন ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে তারা ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নং বাড়িতে কুচকাওয়াজ করে যান এবং সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার বিষয়টি সকাল ৭টার দিকে শুনতে পান সাহারা খাতুন। শুনে সেদিন চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন তিনি। তখন তিনি দৌড়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ইন্দিরা রোডের মরিচা হাউজে গিয়েছিলেন নির্দেশনার জন্য। তখন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেন। তিনি আইনজীবীদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠিত করা শুরু করেন।
এর মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। এর প্রতিবাদে ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি পর্যন্ত মিছিল করেছিলেন সাহারা খাতুন ও তার সঙ্গী-অনুসারীরা।
৫ নভেম্বর চার নেতার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। সাহারা খাতুনের ল’ পরীক্ষার একটি বিষয় ৫ নভেম্বর ছিল। তিনি তখন ভাবলেন পরীক্ষা পরেও দেয়া যাবে। কিন্তু জাতীয় নেতাদের শেষ বিদায় জানানোর সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। সে কারণে সে বৎসর আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এর পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’(অনার্স) কোর্স শুরু হয়ে যায়। তখন শিক্ষকদের পরামর্শে বিজয়নগরে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি হন। আইনপেশায় আসার অদম্য ইচ্ছায় সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে আইনপেশা পরিচালনার সনদপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং আইনপেশা শুরু করেন (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমানের জুনিয়র হিসেবে। এরপর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনপেশা পরিচালনার সনদ পান এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। তিনি পরবর্তীতে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে দেখেন, আইনজীবীদের নিয়ে সকল রাজনৈতিক দল অঙ্গ সংগঠন গড়ে তুলেছে। তখন শেখ হাসিনার সাথে পরামর্শ করে কয়েকজন আইনজীবী নেতাকে নিয়ে সাহারা খাতুন আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ গঠন করেন।
তিনি ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ঢাকা-৫ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন তিনি। আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। তাকে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। পৌনে চার বছরের মাথায় তাকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি পুনরায় ঢাকা-১৮ আসন থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলাগুলি ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু, অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান হাওলাদার, অ্যাডভোকেট মো. মোখলেছুর রহমান বাদলসহ অনেকের সঙ্গে মিলে মোকাবিলা করেছেন সাহারা খাতুন। অন্যান্য নেতাকর্মীদের মামলাগুলিও দেখতেন তিনি।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি প্রথমে নগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। পরে মহিলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক, এরপর সাধারণ সম্পাদিকা এবং একই সাথে নগর আওযামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-আইন সম্পাদিকা, পরে আইন সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। তখন তিনি নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদ এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ আর গ্রহণ করেননি। সবশেষ তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে অনেক আন্দোলন করেছেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন তার শিক্ষক। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে শহীদ জননীর সাথে কাজ করেছেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সভা এবং মিছিলের কর্মসূচি ছিল। সেই সমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করা হয়। সেদিন সাহারা খাতুন মঞ্চে ছিলেন। লাশের সারি দেখে হতবিহবল হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ড. কামাল হোসেনের বাসায় ১৫ ফেব্রুয়ারি জমায়েত হলে শেখ হাসিনা, আবদুস সামাদ আযাদ, মোহাম্মদ হানিফ, মতিয়া চৌধুরী , সাহারা খাতুন ও ড. কামাল হোসেনসহ ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৫ দিন জেল খাটার পর প্রথমে শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী ও সাহারা খাতুনকে গাড়িতে করে যার যার বাসায় নিয়ে নামিয়ে দেয়া হয়।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরত এসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যেদিন যান, সেদিন নেত্রীর সাথে তিনিও সারাদিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিলেন। এরপর প্রায় দুই মাস প্রতিদিন সকালে ৩২ নম্বরে যেতেন, সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় চলে আসতেন সাহারা খাতুন।
তিনি তার জীবনকে আওয়ামী লীগের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। তিনি ব্যক্তিজীবনে অবিবাহিত ছিলেন। যত দিন বেঁচেছিলেন তত দিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে তারই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আস্থা রেখে কাজ করে গেছেন।